fbpx

মশার দখলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম

সম্প্রতি রাজধানীর সব এলাকায় ব্যাপকভাবে বেড়েছে মশার উৎপাত।

রাজধানীর বারিধারার এইচ ব্লকের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মল্লিক আহমেদ।কাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি মালিবাগের বাসায় ফেরেন অফিসের মাইক্রোবাসে। বৃহস্পতিবার মশার উৎপাত নিয়ে ভীষণ ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাসাবাড়িতে তো মশার যন্ত্রণায় থাকা দায় হয়ে পড়েছে। এখন অফিস থেকে ফেরার পথে মাইক্রোবাসেও মশা আর মশা। তাই বাধ্য হয়ে আমরা ৫৫০ টাকা দিয়ে একটি মশা মারার ব্যাট কিনেছি। গাড়িতে বসে মশা মারতে মারতে বাসায় যাই। আর অফিসে তো বসে থাকার উপায় নেই। মশা প্রতিরোধে স্প্রে ছিটানোর পরও কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার মশা চলে আসে। এভাবে আর কত দিন?’ একই কথা বলেন সেগুনবাগিচার বাসিন্দা আতাহার উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বাসায় দরজা-জানালা বন্ধ করে স্প্রে করার পর কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। এখন বাসার বাইরেও হাঁটতে গেলে মশা শরীরে এসে ধাক্কা খায়। কোনো কাজে কোথাও বসা যায় না। এত মশা এর আগে দেখিনি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি রাজধানীর সব এলাকায় ব্যাপকভাবে বেড়েছে মশার উৎপাত। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাস্তায় যাতায়াতের সময়ও মশার হাত থেকে রক্ষা নেই। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী প্রতিনিয়ত অভিযোগ করছে তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছেও। আবার কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে ফগার মেশিন কিনে মশা তাড়ানোর ওষুধ স্প্রে করছে। মশার এ উৎপাতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। মশার কামড়ে পড়ার টেবিলে বসারই উপায় নেই। মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ নানা রোগের আশঙ্কাও করছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বিশেষ ক্রাশ কর্মসূচি হাতে নিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়নি।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জে. শেখ সালাউদ্দিন গতকাল শুক্রবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন মশার প্রজননের উত্তম সময়। তাই মশা বেড়ে যাওয়ার ঘটনাটি স্বাভাবিক। আমরা এ মশক নিধনের জন্য বেশ জোরালো কাজ শুরু করেছি। আমাদের সব লজিস্টিক সাপোর্ট কাজে লাগিয়ে মশক নিবারণে কাজ করছি।’ তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে জনবল আছে তা যথেষ্ট। আর ওষুধও রয়েছে পর্যাপ্ত। তাই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মশার উৎপাত কমিয়ে আনতে পারব।’

ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন বলেন, ‘ছয় মাস আগে আমরা কাউন্সিলররা মশার ওষুধ ছিটানোর কাজে নিয়োজিত লোকবল ও ওষুধ নিজ দায়িত্বে নিয়েছি। তবে যাদের অফিস নেই, সে ক্ষেত্রে নগর ভবন থেকেই মশা নিধন করা হয়। সম্প্রতি মশার উৎপাত কিছুটা বেড়েছে। তবে আমার এলাকায় ব্যাপক ওষুধ ছিটানোর ফলে বংশ বৃদ্ধি না থাকায় এখন উৎপাত কম। সব কাউন্সিলর মশার ওষুধ ছিটানোর কাজটি কঠোরভাবে মনিটরিং করলে সুফল পাওয়া যাবে।’

ডিএনসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজি রজ্জব হোসেন বলেন, ‘বৃষ্টির পর মশা খুব বেড়ে গেছে। মশার উৎপাতের অভিযোগ সব জায়গা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। মিরপুরের যেসব এলাকায় মশার উৎপত্তিস্থল, সেখানে মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ শুরু করেছি। আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যেই মশা কমে আসবে।’

ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। বেশ কিছু যন্ত্র পুরনো, এখন আর কাজ করছে না। ডিএসসিসিতে মশার ওষুধ ছিটানোর মোট ৯৪০টি মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে হাতে চালিত মেশিন ৪৪২টি, ফগার মেশিন ৪৪৭টি ও ৫১টি হুইল ব্যারো মেশিন রয়েছে। ৪৪২টি হাতে চালিত মেশিনের মধ্যে ২০৮টি ও ৪৪৭টি ফগার মেশিনের মধ্যে ১৮৬টি কোনো রকমে ব্যবহার করা যাচ্ছে। ৫১টি হুইল ব্যারো মেশিনের মধ্যে ১৮টি দিয়ে কাজই করা যাচ্ছে না। একই অবস্থা ডিএনসিসিতেও। তাদের ৬৫৩টি মেশিনের মধ্যে হাতে চালিত ৩৮৭টি। আর ফগার মেশিন ২৫৫টি ও হুইল ব্যারো মেশিন ১০টি। এ ছাড়া একটি ভেহিকল মাউন্টেড ফগার মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক মেশিন দিয়ে এখন আর কাজ করা যায় না। এ ছাড়া পুরনো মেশিনে অতিমাত্রায় শব্দ হওয়ায় মশা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরে যাওয়ার মতো ঘটনাও আছে।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জে. শেখ সালাউদ্দিন আরো বলেন, ‘যে কয়জন জনবল আছে, সেই কটি মেশিনও আছে। এখন কতগুলো বিকল বা কাজ হয় না তা তাৎক্ষণিক বলা যাবে না।’

চট্টগ্রামেও মশকরাজ : চট্টগ্রাম নগরে মশার উপদ্রব এত বেড়েছে যে নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের সহযোগিতার চেয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। সম্প্রতি প্র্রকাশিত এ বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে মশা-মাছির উপদ্রব আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।’ চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী বলেন, গত তিন বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশক নিধনে বরাদ্দ ছিল সাড়ে আট কোটি টাকা। এ হিসাব অনুসারে ৬০ লাখ বাসিন্দার নগরে নাগরিকপ্রতি করপোরেশন ব্যয় করছে মাত্র চৌদ্দ টাকা ষোল পয়সা (১৪.১৬ টাকা)। বছর হিসাবে এই বরাদ্দ চার টাকা বাহাত্তর পয়সা মাত্র (৪.৭২ টাকা)।

নগরের নিম্ন আয়ের বেশির ভাগ মানুষ মশা থেকে নিস্তার পেতে কয়েল ব্যবহার করে। চট্টগ্রামের চালিতাতলী এলাকার দোকানি মুনির সওদাগর প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ প্যাকেট (১০টি থাকে), বায়েজিদ থানার আতুরার ডিপো বাজারের নিউ রাউজান স্টোরের মালিক হোসেন সওদাগর ১৫ থেকে ২০ প্যাকেট ও বাকলিয়ার মাইজপাড়া এলাকার হাসান তিন থেকে চার প্যাকেট কয়েল বিক্রি করেন। খুলশী থানার ওয়্যারলেস এলাকার মামুন কলোনির বাসিন্দা রিকশাচালক জীবন জানান, তাঁরা এক কক্ষে ১৫ জন থাকেন। প্রতিদিন চারটি করে কয়েল ব্যবহার করেন। একেকটির দাম আট টাকা। একই এলাকার বিল্লাল কলোনিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন খুলনার বাসিন্দা মফিজুল। পেশায় রিকশাচালক। তিনি জানান, এই কলোনিতে প্রায় এক শর মতো ঘর রয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘরে কয়েল জ্বালানো হয়। নগরের বায়েজিদ থানার চালিতাতলী এলাকার বাসিন্দা ইদ্রিস আলী জানান, তাঁর ঘরে প্রতিদিন চারটি কয়েল ব্যবহার হয়। পাশের ৩০টি ঘরের কমবেশি সবাই কয়েল ব্যবহার করে। বিশেষ করে সন্ধ্যায় বাচ্চারা যখন পড়তে বসে তখন দরকার পড়ে।

নিয়মিত মশার কয়েল ও স্প্রে ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীর ক্যান্সার ঝুঁকির পাশাপাশি ব্রংকাইটিস, দৃষ্টিশক্তি হ্রাসসহ নানাবিধ মারাত্মক রোগ হওয়ার আশঙ্কার কথা জানান চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, কয়েলের ধোঁয়া গর্ভবতী নারী ও শিশুদের দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক ক্ষতি সৃষ্টি করে। চসিক কর্মকর্তা শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী বলেন, জনগণের সার্বিক সচেতনতা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। উৎপাত কমানো যাবে হয়তো। প্রত্যেককে নিজ নিজ আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *