fbpx

বাবা ছেলে আলাদা পথের পথিক

সুনামগঞ্জ রোডে কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের বিপরীত দিকে নেমে যাওয়া পথটিই শেখপাড়ার পথ বাবা ছেলের আলাদা পথের পথিক।

সিলেট শহরতলির টুকেরবাজারের শেখপাড়া গ্রাম। সিলেট সুনামগঞ্জ রোডে কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের বিপরীত দিকে নেমে যাওয়া পথটিই শেখপাড়ার পথ। কংক্রিটে বাঁধানো পথের দু’পাশে ছিমছাম গ্রাম
শেখপাড়া। শহর ও গ্রামের মিশেলে অন্যরকম এক আবহ। দালান আছে, আছে ধানের খেতও। আর কান পাতলে শোনা যায় মূল রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া বাস-ট্রাকের শব্দও।

টুকেরবাজারের শেখপাড়া গ্রামটি এখন দেশজুড়ে আলোচনায়। এ গ্রামেরই বাসিন্দা ফয়জুর রহমানের ছুরির আঘাতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন খ্যাতনামা লেখক ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
মঙ্গলবার ফয়জুর প্রসঙ্গে জানতে তার প্রতিবেশী জামিল আহমদ বুলবুলের বাড়িতে গেলে দেখা যায় বসার রুমের টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছেন ‘লজিং মাস্টার’ তাহির হাসান। কুমারগাঁওস্থ পিডিবির ৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টে কাজ করেন জামিল আহমদ। তিনি জানালেন, কয়েক বছর আগে তাদের এখানে বাড়ি করে এসেছেন ফয়জুরের বাবা হাফিজ আতিকুর রহমান। জামিল আহমদ বললেন, এ সময়ের মধ্যে তিনি ফয়জুরকে এক-দু’বারই দেখেছেন। জানালেন, গ্রামের কারো সঙ্গেই ফয়জুরের পরিচয় নেই। কেউই তাকে চেনেন না। হঠাৎই তাকে দেখা যেত। তবে ফয়জুরের বাবা আতিকুর রহমানকে তিনি নিঃসন্দেহে একজন ভদ্রলোক বলেই মনে করেন। বললেন, নির্বিরোধী এ মানুষটির সঙ্গে গ্রামের সবারই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আতিকুর রহমানের টিউবওয়েল থেকে রমজানে পানিও সংগ্রহ করেন বলে জানালেন জামিল আহমদ।
শেখপাড়া গ্রামে ৬ শতক জায়গার উপর তৈরি হয়েছে ফয়জুরদের বাড়ি। মূল ফটক বন্ধ থাকলেও পকেট গেটটি এখনো খোলাই রয়েছে। সেখান দিয়ে ঢোকার পর দেখা যায় ঘরে প্রবেশের মুখে বারান্দার গ্রিলে তালা দেয়া। তবে ভেতরের দরজাগুলো যে খোলা রয়েছে তা গ্রিলের ফাঁক দিয়েই দেখা যায়। দিন কয়েক আগেই যেখানে একটি পরিবার দিনযাপন করছিল তা এখন একদমই সুনসান। শুধু বাড়ির পাশে এক দুটি মোরগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ির চাবি এখন জালালাবাদ থানার ওসির কাছে রক্ষিত। এর আগে তা ছিল স্থানীয় টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গিয়াস উদ্দিনের কাছে। গিয়াস উদ্দিন জানালেন, তালা খুলে মঙ্গলবার সকালেও পুলিশ ফয়জুরদের বাড়িতে প্রবেশ করে তল্লাশি করেছে।
ফয়জুরের বাড়ির আগেই ‘রুবেল স্টোর’ নামের একটি মনোহারি পণ্যের দোকান। দোকানের স্বত্বাধিকারী মো. জুবের জানালেন, ফয়জুররা বছর কয়েক আগে এখানে এসেছে। কারো সঙ্গেই মিশত না ও। জানালেন, আলাদা পদ্ধতিতে নামাজ পড়ার কারণে তাকে মসজিদ থেকে নিষেধ করা হয়েছিল। তরপর থেকে সে আর মসজিদে আসেনি। জুবেরও বললেন, ফয়জুরের বাবা আতিকুর রহমান অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ। ছেলের একদমই বিপরীত এ মানুষটি সবার সঙ্গে মিলেমিশেই চলতেন।
ফয়জুরের বাড়ির পেছনেই বাস করেন সোনা মিয়া। তিনিও বললেন, ফয়জুরকে হঠাৎই গ্রামে দেখা যেত। তিনিও এক-দুবারই দেখেছেন ফয়জুরকে। জানালেন, সে কারো সঙ্গে মিশত না। বাড়ির পাশে ফেলে রাখা একটি খাম্বার উপর বসে একা একা বিড়বিড় করতো। ফয়জুরের বাবার ব্যাপারে তিনিও ইতিবাচক মন্তব্য করেন। বললেন, আতিকুর রহমান অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ। তার কথা থেকেই জানা গেল, ফয়জুরের বাবার জীবন যে ছেলের জীবনের থেকে একেবারেই আলাদা। অমিশুক ছেলের বাবা সবার সঙ্গে যেমন মিশতেন গ্রামের লোকও তাকে তেমনি শ্রদ্ধা করেন। তিনিই জানালেন, যে মসজিদে ফয়জুরের ব্যাপারে আপত্তি উঠেছে সে মসজিদই ফয়জুরের বাবার মাঝেই ভরসা খুঁজেছে। সোনা মিয়া জানালেন, দিন কয়েক আগে শেখপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মসজিদ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তার অবর্তমানে ফয়জুরের বাবা আতিকুর রহমান মসজিদে বেশ কয়েক ওয়াক্ত নামাজে ইমামতি করেছেন। এমনকি কিছুদিন আগে এক জুমার নামাজে ইমামতি করেছেন, খুতবাও দিয়েছেন।
কথা হয় শেখপাড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফিজ জবরুল ইসলামের সঙ্গে। এখন তিনিই মসজিদে নামাজ পড়াচ্ছেন। মাস তিনেক আগে তিনি মসজিদে যোগ দিয়েছেন। ফয়জুরকে তাই তিনি চেনেন না। তবে ফয়জুরের বাবা আতিকুর রহমানকে ভালোভাবেই চেনেন। তিনিও জানালেন, ইমামের অবর্তমানে মসজিদে নামাজ পড়িয়েছেন আতিকুর রহমান।
ফয়জুর তার নিজগ্রামেও অচেনা এক তরুণ। সবার বিপরীতে অন্য রকম এক জীবন বেছে নিয়েছে সে। বাবা হানাফি মাজহাবের অনুসারী হলেও সে বেছে নিয়েছে সালাফি মতাদর্শ। কোনো মাজহাবের অনুসারী না হওয়ায় সালাফিরা অন্যদের কাছে ‘লা মাজহাবি’ হিসেবেই পরিচিত। নিজেদের আহলে হাদিস হিসেবে পরিচয় দানকারী সালাফিপন্থিদের ইসলামী অনেক আইনের ব্যাপারে মতভিন্নতা রয়েছে। ফয়জুরের ক্ষেত্রেও সে ভিন্নতা চোখে পড়ে তার গ্রামের মানুষের কাছে। তার নামাজ পড়ার ধরন অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা ছিল। তখনই গ্রামবাসী তাকে মসজিদে এভাবে নামাজ পড়তে নিষেধ করেন বলে জানান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গিয়াস উদ্দিন।
সৌদি আরব থেকে বিস্তারলাভকারী সালাফি মতাদর্শ মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকেই ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। ফয়জুরের কাছেও এ মতাদর্শ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকেই। কুয়েতপ্রবাসী দুই চাচা আবদুজ জাহের ও আবদুস সাদিকের অনুপ্রেরণাতেই ফয়জুরের সালাফি আদর্শে দীক্ষা ঘটেছে বলে জানা গেছে। আর এ আদর্শ সবার সঙ্গে ফয়জুরের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। বাবার সঙ্গে বৈপরীত্যও গড়ে দিয়েছে এ আদর্শই।
ফয়জুর এখন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১২নং ওয়ার্ডের ২৭নং কেবিনে সার্জারি ইউনিট-২ এ প্রফেসর আবদুস সামাদ আজাদের অধীনে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে সে অনেকটাই সুস্থ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেশ কিছু তথ্যও দিয়েছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনায় হাসপাতালেই রাখা হয়েছে তাকে। তবে প্রফেসর আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অপরদিকে ফয়জুর রহমানের বাবা আতিকুর রহমান ও মা মিনারা বেগম এখন পুলিশের জিম্মায় দিন কাটাচ্ছেন। ফয়জুরের কাছ থেকে কি তথ্য পাওয়া গেছে- এমন জিজ্ঞাসার জবাবে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।
জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক হওয়া সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনের কম্পিউটার ব্যবসায়ী মঈনুল হককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে মঙ্গলবার। তবে তার দোকানের অপারেটর এখনো পুলিশ হেফাজতেই রয়েছে। ফয়জুর কয়েক দফায় এ দোকানে কাজ করেছে। পুলিশ এখনো চোখ রাখছে রাজা ম্যানশনে। আশপাশের দুয়েকটি দোকান থেকে ল্যাপটপ-কম্পিউটারও জব্দ করেছে পুলিশ।
গত শনিবার সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে খ্যাতনামা লেখক-শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুলকে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকরা আটক করেন। গণধোলাইয়ে আহত ফয়জুর রহমান সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *