আত্মশুদ্ধির প্রধান সোপান
রমজান মাসই হল আত্মশুদ্ধির প্রধান সোপান
আত্মশুদ্ধির প্রধান সোপান
সাংবাদিক মোঃ মহসিন হোসাইনঃ রমজান মাস অন্যসব মাসের মত সাধারণ কোন মাস নয়। এটি অত্যন্ত পবিত্র মাস, পূণ্যের মাস। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস মাহে রমজান। এই পুরো মাসটিই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পূর্ণ। এই মাসেই পবিত্র কোরআন মাজিদ নাযিল হয়েছে।
তাই এই পবিত্র মাসে রোজা বা সিয়াম সাধনাকে আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন প্রত্যেক ঈমানদার নর-নারীর উপর ফরজ বা বাধ্যতামূলক করেছেন। শুধু আল কোরআনই নয়, অন্যান্য প্রধান প্রধান আসমানি কিতাবও রমজান মাসেই নাযিল হয়েছিল এবং একারণে পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও রমজান মাসে সিয়াম সাধনা বাধ্যতামূলক ছিল। যেমন পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন স্বয়ং বলেন:
‘হে মু’মিনগণ! তোমাদের তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হইল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হইয়াছিল, যাহাতে তোমারা মুত্তাকী হইতে পার।’ -[বাকারা : ১৮৩]
রমজান মাসের পুরো সময় রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা মৌলিক ইবাদতের অন্যতম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন- পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের বুনিয়াদ স্থাপিত। এগুলো হলো- ১.ঈমান- আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ’র রাসূল এই প্রত্যয় ব্যক্ত করা; ২. নামাজ কায়েম করা; ৩. যাকাত প্রদান করা; ৪. রমজান মাসের রোজা রাখা এবং ৫. বাইতুল্লা’য় হজ্জ করা।
এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয় এবং প্রধানদ প্রধান শয়তানগুলোকে বন্দী রাখা হয়। তাই এ মাসে সাধারণভাবে ঈমানদারদের দিল নরম থাকে, তাদের হৃদয়, মন ও আত্মা আল্লাহ’র দিকে, মহান সৃষ্টিকর্তার দিকে রুজু থাকে।
পবিত্র এই মাস অশেষ পূণ্যের মাস। মহানবী (সা.) শাবান মাসের শেষ দিন সাহাবীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে পবিত্র রমজান মাসের আগমন বার্তা ঘোষণা করে এই মাসকে এক মহিমান্বিত ও বরকতময় মাস হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এই মাসে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। বলাবাহুল্য, এই রাতটির নাম ক্বদরের রাত। মহানবী জানিয়েছেন, এ মাসের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাত সমূহের মধ্যেই ক্বদরের রাত নিহিত থাকে। এই শেষ দশদিনে মুসলমানদেরকে এতেকাফে বসার জন্যও তাগিদ দিয়েছেন তিনি। ক্বদরের রাত ছাড়াও এ মাসের প্রতিটি রাত, প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। মহানবী (সা.) বলেছেন, এই পবিত্র মাসে যে একটি নফল ইবাদত করবে সে অন্য সময়ে একটি ফরজ ইবাদত করার সমান পূণ্য লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের পূণ্য লাভ করবে।
মনে রাখতে হবে, সিয়াম শুধু মাত্র সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকার নাম নয়, বরং এটি রীতিমত একটি সাধনার নাম। রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করা। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহকে ভয় করে, ভালোবেসে চলা; তার আদেশ নিষেধ মেনে চলা। আত্মশুদ্ধি এবং স্রষ্টার নৈকট্য লাভ ছাড়া এই গুণাবলী অর্জন সম্ভব নয়। অনেককেই দেখা যায়, রোজা রাখা সত্বেও নামাজ পড়ে না, টেলিভিশন ও সিনেমা দেখে সময় কাটায়। এ থেকে বুঝা যায়, রোজার তাৎপর্য তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে রোজা আর উপবাস/অনশন এক নয়। রোজা রেখে যদি খোদাভীতি অর্জন করা না যায় তাহলে কোন লাভ নেই। কারণ খোদাভীতি অর্জন করাই রোজার মূল উদ্দেশ্য, যা আমরা উপরে উল্লেখিত আয়াত থেকেই জানতে পেরেছি। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা কাজ থেকে বিরত থাকতে পারল না, তার রোজা রেখে পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহ কোন প্রয়োজন নেই।’ আল্লাহকে ভয় করে চলা মানে যেমন তাঁর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা তেমনি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করা
রমজান মাসে তাকওয়াঃ
রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়।আরবি ‘তাকওয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আল্লাহভীতি, পরহেজগারি, দ্বীনদারি, ভয় করা, বিরত থাকা, বেছে চলা, আত্মশুদ্ধি, আত্মবোধের জাগৃতি, নিজেকে কোনো বিপদ-আপদ বা অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি। শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানবজীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া। এককথায় যাবতীয় অসৎ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে পরিশুদ্ধ জীবন পরিচালনার নামই তাকওয়া।ইসলামে তাকওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান কোনো কাজ নেই। দ্বীনের প্রাণশক্তিই হলো এ তাকওয়া।তাকওয়া মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ইহকালীন জীবন শান্তিময় করার এবং পারলৌকিক কল্যাণের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া।তাই রমজান মাসে তাকওয়া অর্জনে ব্রতী হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্যকর্তব্য। বান্দার মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
প্রতিটি কাজের জন্য সর্বদ্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভূতিকে তাকওয়া বলে। হাদিস শরিফের আলোকে তাকওয়ার সংজ্ঞা হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) যা করতে বলেছেন তা করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। ইমান-আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব বৈরী পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে স্বীয় মহৎ বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে জীবন যাপন করার নামই তাকওয়া। (ইয়াহ্ইয়া উলুমুদ্দীন) তাই কোনো রোজাদার মুমিন মুত্তাকি কখনো তিরস্কার, ব্যঙ্গোক্তি, অবজ্ঞা, দাম্ভিকতা, গর্ব-অহংকার, কটূক্তি, দম্ভোক্তি, কুৎসা রটনা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা তুচ্ছজ্ঞান করতে পারে না। সে কখনো দুরাচার, পাপিষ্ঠ, কদাচার, দুশ্চরিত্র, দুষ্কর্ম ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
মাহে রমজানের সিয়ামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাকওয়া হচ্ছে হৃদয়ের এক বিশেষ অবস্থার নাম।তাকওয়া হলো আল্লাহর বিধিবিধান পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা।তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে না পারলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা অসম্ভব। তাকওয়ার মাধ্যমেই বান্দা ইহকাল ও পরকালে তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে পরম সম্মানিত হয়। যত প্রকার ইবাদত-বন্দেগি ও ইসলামের বিধিবিধান রয়েছে সবকিছুর মূলে রয়েছে তাকওয়ার অনুপ্রেরণা।
ই’তিকাফ
রোজার উপকারীতা সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক। আর এ তিনটি উপকারীতার সমন্বয় ও স্রষ্টার সান্নিধ্য অর্জনের সুযোগ রয়েছে হয়েছে মাহে রমজানের শেষ দশকে তথা আজ থেকে শুরু হওয়া ই’তিকাফে। যাকে ইবাদতের ‘মেডিটেশন’ বলা হয়। ই’তিকাফের শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা, কোন বস্তুর ওপর স্থায়ীভাবে থাকা, আবদ্ধ করে রাখা। ই’তিকাফের মধ্যে নিজের সত্তাকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয় এবং নিজেকে মসজিদ হতে বের হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। শরিয়তের পরিভাষায় ‘ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়ত সহকারে পরুষের ঐ মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামা’আতের সাথে আদায় করা হয় অথবা কোন মহিলার নিজ ঘরে নামাজের ¯া’নে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলা হয়’। ২০ রমজান তথা আজ আসর নামাজের পর সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে শাওয়ালের নতুন চাঁদ উদয় হওয়া তথা ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ই’তিকাফ পালন করতে হবে। ইমামদের সর্বসম্মত মতানুযায়ী ই’তিকাফ পালন করা সুন্নাত। তবে আমাদের হানাফী মাযহাব মতে ই’তিকাফ ‘সুন্নাতে মু’আক্কাদা আলাল কিফায়া’ অর্থাৎ মসজিদের সকলের (মুসল্লিদের বা মহল্লার) মধ্য হতে কোন এক ব্যক্তি ই’তিকাফ পালন করে সকল মুসল্লি বা মহল্লার সবার পক্ষ হতে আদায় হয়ে যাবে। আর যদি মহল্লার সবার পক্ষ হতে কেউ পালন না করে তবে সবাই গুনাহগার হবে (ফতোয়ায়ে আলমগীরী, দুররে মুখতার)। ই’তিকাফের জন্য জামে মসজিদ হওয়া শর্ত নয় বরঞ্চ যে মসজিদে ইমাম ও মোয়াযযিন নিয়োজিত আছেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামা’আত সহকারে আদায় হয়, সে সব মসজিদে ই’তিকাফ করা জায়েজ। (বাহারে শরীয়ত ও তাহতাবী)। মর্যাদায় ই’তিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, এরপর মসজিদে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপর মসজিদে আক্বসা এরপর ঐ জুমু’আর মসজিদ যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামা’আতের সাথে আদায় করা হয়। এরপর সে মসজিদ যেখানে মুসল্লির সংখ্যা অধিক হয়ে থাকে (শামী ২য় খন্ড ও আলমগীরী ১ম খন্ড, বাহারে শরীয়ত)। ইমাম আযম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত আছে যে, ই’তিকাফ সহীহ হবে এমন মসজিদে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামা’আতের সঙ্গে আদায় করা হয় (হিদায়া ১ম খন্ড)। মহিলাগণ নিজ ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় ই’তিকাফ করবেন।