মাশরাফির মতো হবি’
‘মা বলেছেন, হলে মাশরাফির মতো হবি’
হলে মাশরাফির মতো হবি
আড়মোড়া ভেঙে আবারও জাগছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম। কদিন আগে ৩১ জনের প্রাথমিক দল দিয়েছে বিসিবি, যেটির ক্যাম্প শুরু হচ্ছে কাল থেকে। রোববার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে এই ক্যাম্পে যোগ দিতে আসবেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম থেকে শুরু করে জাতীয় দলের প্রায় সব ক্রিকেটার। ক্রিকেটারদের এই ভিড়ে থাকবেন ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ পেসারও।
সবার কথা বাদ দিন, প্রাথমিক দলে থাকতে পেরে ইয়াসিন আরাফাত নিজেই ভীষণ অবাক। ভরদুপুরেও তাঁর মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছেন না তো! মাত্রই প্রাথমিক দলে সুযোগ পেয়েছেন। সামনে এখনো দীর্ঘ পথ। জুনে আফগানিস্তান কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে যখন দল ছোট হয়ে আসবে, তাতে তাঁর নাম থাকলে সেটি হবে আরও এক বিস্ময়ের।
তবু ইয়াসিন যে প্রাথমিক দলে ডাক পাবেন, সেটিও কি কম চমকের! ‘আমি ভেবেছিলাম হয়তো এইচপি (হাইপারফরম্যান্স) বা “এ” দলে রাখবেন নির্বাচকেরা। কিন্তু বাংলাদেশ প্রাথমিক দলে জায়গা হবে কল্পনাতেও ছিল না। মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিক ভাইদের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুমে শেয়ার করব, একসঙ্গে অনুশীলন করব, ভাবতেই অন্য রকম লাগছে!’—আজ দুপুরে বিসিবি একাডেমি মাঠে ইয়াসিনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, চোখেমুখে তাঁর বিস্ময় আর রোমাঞ্চের ছোঁয়া।
নোয়াখালী থেকে উঠে আসা ইয়াসিনের বাবা ওমানপ্রবাসী নুরুল আমিন চাননি ছেলে ক্রিকেটার হোন। বাবা পছন্দ করেন না বলে বিকল্প উপায় বের করতে হয়েছে তাঁকে। দোকানে লুকিয়ে রাখতেন ক্রিকেট সরঞ্জামাদি। মাঠে যাওয়ার আগে সেখান থেকে নিয়ে যেতেন, বাসায় ফেরার সময় আবার রেখে আসতেন। ক্রিকেটের প্রতি ছেলের এই ভালোবাসা দেখে মা আনোয়ারা বেগম ইয়াসিনকে বলতেন, ‘ক্রিকেটার যদি হতেই হয়, মাশরাফির মতো হবি।’
মায়ের কথা সামনে এগিয়ে যেতে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে তাঁকে। স্বপ্নের দিগন্তটা আরও বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার উপায় কী? এই পথটা ইয়াসিনকে দেখিয়ে দিলেন তাঁর গৃহশিক্ষক মামুন আহমেদ। জীবনের মোড়টা ঘুরে গেল ২০১১ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর। ‘ভর্তির প্রক্রিয়াটা জানতাম না। আমার ওই স্যারের ভাইয়ের বাসা সাভারে, বিকেএসপির কাছে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, বিকেএসপিতে ভর্তির প্রক্রিয়া খোঁজখবর নেবেন আমার জন্য। স্যারের সহযোগিতায় ২০১০ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিল, উত্তীর্ণ হতে পারিনি। পরের বছর আবার দিতে চাইলাম। বাবা অবশ্য নিরুৎসাহিত করলেন। বললেন, একবার যখন হয়নি পড়াশোনাতেই মনোযোগ দাও। এই এক বছর নোয়াখালীতে অনেক টুর্নামেন্ট খেলেছি। একটু অভিজ্ঞতাও হলো। পরেরবার পরীক্ষায় মেধাতালিকায় চতুর্থ হলাম। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পরও স্যার আমাকে অনেক সহায়তা করেছেন’—ইয়াসিন বলছিলেন কীভাবে তিনি পেরিয়েছেন একেকটি সিঁড়ি।
গত বছর বিকেএসপি পাট চুকিয়ে জায়গা পেলেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। কিন্তু পিঠের চোটের কারণে ইয়াসিন খেলতে পারেননি সবশেষ যুব বিশ্বকাপ। এখন পর্যন্ত ইয়াসিনের অভিজ্ঞতা বলতে ৪টি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও ৫টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলা। লিস্ট ‘এ’-তে যে ৫টি ম্যাচ খেলেছেন, এর চারটিই সবশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। ১৪ মার্চ ফতুল্লায় গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের হয়ে আবাহনীর বিপক্ষে পেয়েছিলেন ৪০ রানে ৮ উইকেট। কদিন পর বিসিএলের পঞ্চম রাউন্ডে উত্তরাঞ্চলের হয়ে পূর্বাঞ্চলের বিপক্ষে ৭ উইকেট নিয়ে হলেন ম্যাচসেরা। এ দুটি ম্যাচের পারফরম্যান্স দিয়েই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন নির্বাচকদের।
বিসিবির বয়সভিত্তিক দলের কোচ মাহবুব আলীর অধীনে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ইয়াসিনের বোলিং নিয়ে মাহবুবের বিশ্লেষণ, ‘জোরে বোলিং করতে পারে। ভালো উচ্চতা আছে, এটা তাঁর শক্তির জায়গা। পিচে হিট করে বল ভালো উচ্চতায় তুলতে পারে। তবে এখনো অনেক কাজ করতে হবে তাকে। উন্নতির অনেক জায়গা আছে।’
দ্রুত প্রাথমিক দলে জায়গা পেয়েছেন বলে এখনই চূড়ান্ত স্কোয়াডে ঠাঁই পাবেন, ইয়াসিন নিজেও সে আশা করেন না। তবে স্বপ্নপূরণের একটা ধাপে পা রাখতে পেরে যেমন খুশি, তেমনি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে তাঁকে, ‘মাশরাফি-সাকিব ভাইদের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুম শেয়ার করব, এটা আমার জন্য বিরাট প্রাপ্তি। জানি না কত দূর যেতে পারব, চেষ্টা করব সিনিয়রদের কাছ থেকে কিছু শিখতে।’
ইয়াসিনের আদর্শ যে মাশরাফি, শুরুতেই জানিয়েছেন। স্বপ্ন দেখেন মাশরাফির মতো দীর্ঘদিন সেবা দিতে বাংলাদেশ দলকে। একজন মাশরাফি হতে হলে কতটা পথ হাঁটতে হবে, অজানা নয় ইয়াসিনের।