মাহাথির মোহাম্মদ আসলে কী চান ?
২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরে দাঁড়িয়েছিলেন মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ।
এর আগে জনপ্রিয়তার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে বরখাস্ত করে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন তিনি। রাজনীতির খেলায় এখন ফের আনোয়ারের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন মাহাথির। দুই সাবেক শত্রুর চক্ষুশূল এখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক।
৯২ বছর বয়সে আবার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতির মঞ্চে হাজির হয়েছেন মাহাথির। যে দলের হয়ে এর আগে পাঁচটি নির্বাচনে জিতেছিলেন তিনি, এবার দাঁড়াচ্ছেন তারই বিরুদ্ধে। কারণ, সেই ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) নেতৃত্ব এখন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের হাতে। নাজিবকে কোণঠাসা করতে হলে নির্বাচনে ইউএমএনওকে পরাজিত করার কোনো বিকল্প নেই।
এমন পরিস্থিতিতে একদা বন্ধু থেকে শত্রু বনে যাওয়া আনোয়ার ইব্রাহিমকেই বুকে টেনে নিয়েছেন মাহাথির। আনোয়ার ছিলেন মাহাথির পরবর্তী যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। অথচ ১৯৯৮ সালে সেই আনোয়ার ইব্রাহিমকেই বরখাস্ত করেন মাহাথির। পরে তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ। মালয়েশিয়ায় সমকামিতাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার শুরু হওয়ার পরই ভোটের ময়দান থেকে ছিটকে পড়েন আনোয়ার। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
এরপর ২০১৪ সালে আনোয়ারের বিরুদ্ধে আবার সমকামিতার অভিযোগ আনা হয়। আনোয়ারের ভাষ্য, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতেই দ্বিতীয় দফায় একই অভিযোগ আনা হয়। কারণ, এর ঠিক এক বছর আগের সাধারণ নির্বাচনে কারাগার থেকে মুক্ত আনোয়ারের নেতৃত্বে দেশটির বিরোধী জোট অপ্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছিল। নাজিব রাজাকের নেতৃত্বাধীন জোট ওই নির্বাচনে পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ আসন ধরে রাখতে পারলেও ধস নেমেছিল জনপ্রিয়তার একচ্ছত্র রাজত্বে।
এই পুরোটা সময় ‘সাবেক বন্ধু’র বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। অথচ ৭ জানুয়ারি এত দিনের ‘শত্রু’ আনোয়ারকে ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসেবে অভিহিত করে মাহাথির বলেছেন, আনোয়ার তাঁকে কৃতজ্ঞতার বাঁধনে বেঁধেছেন! দ্য মালয় মেইল অনলাইনের খবরে প্রকাশ, মাহাথির বলেছেন, ‘আমাকে গ্রহণ করা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। আনোয়ার ও তাঁর পরিবার ২০ বছর ধরে অনেক ভুগেছে। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।’
তবে নিজেকে ‘নিষ্ঠুর’ মানতে নারাজ মাহাথির মোহাম্মদ। এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জানি আমি নিষ্ঠুর নই। অভিযোগকারীরা স্রেফ বলার জন্য এসব বলছে। কিন্তু এসব বলে মূল দায়িত্ব পালন থেকে আমাকে থামানো যাবে না।’
অন্যদিকে, মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক দুর্নীতির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় তহবিল ওয়ানএমডিবি (ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বারহাদ) কেলেঙ্কারিতে জেরবার নাজিব। যতই মুখে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করুন না কেন, নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারছেন না তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এরই মধ্যে বলে দিয়েছে, ওয়ানএমডিবিতে নয়ছয় হয়েছে মালয়েশীয় সরকারের প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
নাজিবের এই নড়বড়ে অবস্থাকে পুঁজি করেই এক হয়েছেন মাহাথির ও আনোয়ার। এখন দুজনেরই শত্রু এক। সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে একজোট হওয়া সম্পর্কে মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের কবল থেকে মুক্ত হতে এটি করা হয়েছে। নাজিবের থেকে মুক্তি চায় আনোয়ার। আমিও তা-ই চাই। নাজিবকে সরাতে হলে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই অতীতকে ভুলে যেতে হবে।’
রাজনীতির অঙ্ক
মালয়েশিয়ার বিরোধীদলীয় জোট পাকাতান হারাপান গত রোববার মাহাথির মোহাম্মদকে আসন্ন ১৪তম জাতীয় নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিরোধীদলীয় জোট জিতলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী নেতা হবেন মাহাথির। আর দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী করা হয়েছে আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইলকে।
আনোয়ার ইব্রাহিম এখনো কারাগারে আছেন। বিরোধীদলীয় জোটে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শুরু হবে আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ে আসার কাজ। ২০১৪ সালে আনা সমকামিতার অভিযোগে দণ্ডিত হওয়ায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারিয়েছেন আনোয়ার। একমাত্র রাজকীয় ক্ষমা পেলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা ফিরে পাবেন। চুক্তি অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী হলে মাহাথির সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবেন এবং প্রধানমন্ত্রী হবেন আনোয়ার।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেছেন, ‘বিরোধীদলীয় জোট ২০১৩ সালে পপুলার ভোটে জিতেছিল। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার সাধারণ মানুষের ভোট পায়নি তারা। তারা ভাবছে আমি এগুলো এনে দিতে পারব।’
মালয়েশিয়ায় এখন ক্ষমতায় আছে বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) নামের জোট। এই জোটের মূল দল নাজিবের ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও)।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিএনকে ক্ষমতা থেকে সরানো বেশ কঠিন। ২০১৩ সালের নির্বাচনের চেয়েও দুর্বল অবস্থায় আছে বিরোধীদলীয় জোট। তা ছাড়া জোটে এরই মধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দু-একটি রাজনৈতিক দল নিজেদের জোট থেকে সরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে, স্বদেশে আগের মতো আর প্রভাব নেই মাহাথিরের। সব মিলিয়ে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই বিরোধীদের জোট। ভোটের আগে যদি আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়, তবে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো খুবই কঠিন হবে।
ভোটের হিসাব
গত ডিসেম্বর মাসে চালানো এক জরিপের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম দ্য মালয়েশিয়ান ইনসাইট জানিয়েছে, পপুলার ভোটে আগের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়েছে ক্ষমতাসীন বিএন। কিন্তু এখনো পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া তাদের জন্য কঠিন কিছু হবে না।
মেরদেকা সেন্টারের চালানো জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচনী সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করায় বিপদে পড়ে গেছে বিরোধীদলীয় জোট পাকাতান হারাপান। সমালোচকেরা বলছেন, এতে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা। মেরদেকা সেন্টারের পরিচালক ইব্রাহিম সুফিয়ান বলেন, ‘বিরোধীদের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সন্দিহান। যদি জোটের ভেতরের সমস্যা সমাধান করা না যায়, তবে এ ব্যাপারে কোনো আশা নেই।’
পেনাং ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. ওই কিই বেং মনে করেন, নাজিব রাজাকের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মাহাথির ও আনোয়ারের জোট। চ্যানেল নিউজ এশিয়াতে লেখা এক মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, নাজিবের জনপ্রিয়তা এখন কম। আগেকার দিনে ইউএমএনও যতটা জনপ্রিয় ছিল, সেই তুলনায় নাজিবের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। দেশটির রক্ষণশীল জনগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে পারলেও মালয় জনগণের অন্যান্য অংশের বিরাগভাজন হয়েছেন নাজিব। মালয়েশিয়ার সুলতান ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাও তাঁকে এখন আর পছন্দ করছেন না।
ড. ওই কিই বেং বলেন, মালয়েশিয়ার মানুষ এখনো ইউএমএনওর মোহ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু ওই দলের অন্যতম পরিচিত ব্যক্তিত্ব মাহাথির মোহাম্মদ দল থেকে পদত্যাগ করে বিরোধী শিবিরে যোগ দেওয়ায় ভোটাররা বেশ সংশয়ে থাকবেন। আর সেটিই হতে পারে বিরোধীদলীয় জোটের জেতার সুযোগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইউএমএনওর পাঁড় সমর্থকদের নিজেদের দিকে টানতে হবে বিরোধীদের। সেটিই মূল চ্যালেঞ্জ।
মাহাথির কী চান?
ক্ষমতা ছাড়ার পর কোনো উত্তরসূরিকেই শান্তিতে থাকতে দেননি মাহাথির মোহাম্মদ। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তিনি স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার পর সেখানে আসেন আবদুল্লাহ আহমাদ বাদাবি। ক্ষমতার বাইরে থেকে অনবরত বাদাবির সমালোচনা করেছেন মাহাথির। বাদাবি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই ২০০৮ সালে ইউএমএনও থেকে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি।
তবে নাজিবের বিষয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রমণাত্মক মাহাথির। ২০০৯ সালে যখন নাজিব ক্ষমতায় আসেন, তখন আবার দলে ফিরে এসেছিলেন মাহাথির। কিন্তু সেই সদ্ভাব বেশি দিন থাকেনি। এখন ফের দল থেকে পদত্যাগ করে নাজিবের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাহাথির দাবি করেছেন, তাঁর উত্তরসূরিরা ‘ভুল কাজ’ করেছিলেন বলেই সমালোচনা করেছিলেন তিনি। একই সঙ্গে মাহাথির এও বলেন, নাজিবকে সরাতে ‘বিরোধীরা তাঁকে ব্যবহার করায়’ কিছুই মনে করছেন না। এ থেকেই বোঝা যায়, নাজিবকে ক্ষমতা থেকে সরাতে কতটা মরিয়া এই ৯২ বছর বয়সী রাজনীতিক! তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এ কাজ আমাকেই করতে হবে। কিছু স্বার্থপর মানুষ এই দেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। আমি এটি মেনে নিতে পারব না। এরা শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবে…অর্থ চুরি করে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাহাথিরের শাসনামলে মালয়েশিয়ার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দেশটির অনেক মানুষই তাঁকে ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে দেখেন। বিশেষ করে, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা নাজিবকেই পছন্দ করেন। তা ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোটাররাও সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে মোটামুটি সন্তুষ্ট। তাঁরা বরং রাজনৈতিক স্থিরতা চান।
কুয়ালালামপুরের ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের প্রধান নির্বাহী ওয়ান সাইফুল ওয়ান জান মনে করেন, মালয়েশিয়ায় ভোটের রাজনীতিতে এখনো প্রভাবশালী মাহাথির। তিনি বলেন, ভোটারদের আকৃষ্ট ক্ষমতা আছে মাহাথিরের। বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকার ভোটারদের কাছে তাঁর আবেদন আছে।
মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় সদস্য চার্লস সান্টিয়াগো সিএনএনকে বলেন, নাজিবকে ঠেকাতে মালয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন ছিল আমাদের। মাহাথির সেই জায়গা নিয়েছেন। আর রাজনীতি খুব অদ্ভুত জিনিস। এক মিনিট আগেও হয়তো আপনি আমার শত্রু ছিলেন, পরক্ষণেই হয়ে যাবেন বন্ধু।