fbpx

ভারী অস্ত্র নিয়ে মিয়ানমার বাহিনী

সীমান্তে ভারী অস্ত্র নিয়ে মিয়ানমার বাহিনী

এপার-ওপারের মাঝখানে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে আতঙ্কে সময় পার করছে হাজারো রোহিঙ্গা। ওপার থেকে ক্ষণে ক্ষণে মাইকে ঘোষণা আসছিল, আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত সরে যেতে হবে।

আজ সকাল সাড়ে আটটায় শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের একেবারে কাছে (তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ায়) গিয়ে দেখা গেছে, ট্রাকে করে সীমান্তে সেনাসমাবেশ ঘটাচ্ছে মিয়ানমার। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ওই সীমান্তে ১৪-১৫টি ট্রাকে আনা হয়েছে তিন শতাধিক সেনা। আগের দিন বৃহস্পতিবার সেখানে আনা হয়েছিল সাত-আটটি ট্রাকে করে আরও ২০০ সেনাসদস্য।

পাথরকাটা নামের ছোট একটি খালের ওপারে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরটি দাঁড়িয়ে আছে। শিবিরের পেছন লাগোয়া মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পাশে যানবাহন চলাচলের রাস্তা। তারপরে উঁচু-নিচু পাহাড়। কাঁটাতারের বাইরে ১০ গজ অন্তর দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন সে দেশের ভারী অস্ত্রধারী সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পাহাড়ে চূড়ায়, ঢালুতে এবং খেজুর ও আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে সেখানকার শতাধিক সেনাসদস্যকে। তাঁদের অনেকে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এপারের ছবি ও ভিডিও চিত্র ধারণ করছিলেন।

পাথরকাটা খালের এপারে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয়, তুমব্রু বিজিবি ক্যাম্প প্লাটুন কমান্ডার বদিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকাল ছয়টার পর থেকে সীমান্তে অতিরিক্ত সেনাসমাবেশ ঘটাতে থাকে মিয়ানমার। বেলা ১১টা পর্যন্ত ১৫টি ট্রাকে আনা হয়েছে তিন শতাধিক সেনা। সেনাদের পাশাপাশি সে দেশের সীমান্ত পুলিশ বিজিপিও টহল দিচ্ছেন। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের সরে যেতে তাঁরা অনবরত মাইকিং করে চলেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে সেনারা একটি গুলি ছোড়ে। তারপর গভীর রাত পৌনে তিনটার দিকে আরেকটি গুলি ছোড়ে। উদ্দেশ্য শূন্যরেখায় আশ্রয়শিবিরে থাকা প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়া থামিয়ে দেওয়া। গুলিবর্ষণের ঘটনায় সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত বিজিবির কয়েকজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, সেখানকার সেনাবাহিনীর সদস্যরা কে কী করছেন, তা তাঁরা নিকটতম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যক্ষ করছেন। এপারে দাঁড়িয়ে সবকিছু খালি চোখে দেখা যায়।

মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা জি-থ্রি, একে-৪৭, চায়নিজ রাইফেল, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহারা বসিয়েছেন। ট্রাক থেকে আনা হয়েছে রকেটলঞ্চার, মর্টার। এসব মর্টার থেকে ৬০-৭০ মিটার দূরত্বে শেল নিক্ষেপ করা যাবে। পাহাড়ের চূড়ায় পলিথিনের বেড়া দিয়ে তৈরি হয় একাধিক ছাউনি। পাহাড় খনন করে তৈরি হচ্ছে করা অসংখ্য বাংকার। সেখানে ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহারা বসিয়েছেন সেনাসদস্যরা। এসব পরিস্থিতি দেখে স্থানীয় লোকজন আতঙ্কিত।

বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে গুলিটি ছুড়েছিল, সেটি এসে পড়ে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা আমির হোসেনের ঘরে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গুলিটি প্রথমে ঘরে রাখা দুই লিটার পরিমাণ সয়াবিন তেলের একটি প্লাস্টিক বোতল ভেদ করে একটি ব্রিফকেসে লাগে। তখন ব্রিফকেসে থাকা তিন জোড়া কাপড় পুড়ে যায়। এরপর বিজিবি সদস্যরা গুলিটি নিয়ে গেছে। তখন ঘরে কেউ ছিল না বলে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তাঁরা।

আমির হোসেনের বাড়ির ৩০ গজ পেছনে মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। সেখানে দাঁড়িয়ে এদিকে অস্ত্র তাক করে আছেন সেখানকার ১০-১২ জন সেনাসদস্য। রোহিঙ্গাদের ছবি তোলা দৃশ্য দেখে সেনাসদস্যরা ওপারে হইচই শুরু করেন। সেনাসদস্যদের পাশের একটি তল্লাশিচৌকি থেকে তখন মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, প্রথমে বার্মিজ ভাষায় এবং পরে রোহিঙ্গাদের আঞ্চলিক ভাষায়। ঘোষণায় বলা হচ্ছিল, ‘রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলাজুড়ে এখন ১৪৪ ধারা চলছে। শূন্যরেখার যে স্থানে ধাওয়া বাঙালিরা (পলাতক বাঙালি) অবস্থান করছ, সেটি মিয়ানমারের ভূখণ্ড। সুতরাং এই ভূখণ্ডে বাঙালিদের (রোহিঙ্গা) থাকা বেআইনি। তাই দ্রুত এই ভূখণ্ড ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। অন্যথায় কোনো কিছুর জন্য মিয়ানমার দায়ী থাকবে না।’

এখানে উপস্থিত বিজিবি সদস্যরা বলেন, প্রতিদিন এ রকম ১৫-১৬ বার ঘোষণা দেয় তারা। কিন্তু রোহিঙ্গারা তা কানে নিচ্ছে না।

বেলা ১১টার দিকে তুমব্রু সীমান্তে কথা হয়, বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমার তাঁদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে পারে, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁরা গুলি করছে কেন? এ নিয়ে মিয়ানমারের কাছে প্রতিবাদ পাঠিয়েছে বিজিবি। পাশাপাশি বিজিবিও সতর্ক রয়েছে। ওপারের ঘটনায় এপারের লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির থেকে গত দুই দিনে কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ঢোকেনি।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম সরওয়ার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তের শূন্যরেখায় সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে মিয়ানমার। উদ্দেশ্য—রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ ও সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা।

গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইন রাজ্য থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পালিয়ে আসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে ইতিমধ্যে ১০ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *