fbpx

জাতীয় পুরষ্কার বিজয়ী একজন মাটি ও মানুষের গল্প

শাইখ সিরাজ বাংলাদেশী সাংবাদিক, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। জাতীয় পুরষ্কার বিজয়ী একজন মাটি ও মানুষের গল্প।

শাইখ সিরাজ কৃষি সাংবাদিকতাসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনে জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনেজনপ্রিয় কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান মাটি ও মানুষ ও নিজস্ব মালিকানাধীন বেসরকারি টিভি চ্যানেল চ্যানেল আইতে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ নামক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। কৃষি সাংবাদিকতায় অবদান রাখার জন্য ২০১৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

অনাদিকাল ধরেই এ দেশ কৃষিপ্রধান, কিন্তু কৃষির এ দেশে কৃষকের কথা শোনার কোনো মানুষ ছিলো না, তাদের হয়ে আওয়াজ তোলার কোনো কন্ঠ ছিলো না; বস্তুগত কোনো প্রাপ্তিযোগের আশায় নয় বরং দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি নাড়ির টানে তিনি তাঁর কর্ম-ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে বেছে নিয়েছেন ওই ‘চাষা-ভূষাদের’। কৃষকদের নিয়ে পুরাকালে কোনো এক কবি বলেছিলেন, ‘দধীচী কি তাঁহার চেয়ে সাধক ছিলেন বড়ো, পুণ্য অতো হবে নাকো সব করিলে জড়।’ আর এ কালে, যাদের কথা কেউ বলে না, যাদের দিকে কেউ দৃষ্টি দেয় না, যারা অপাঙ্ক্তেয়, চির অবহেলিত, সেই কৃষকদেরই শাইখ সিরাজ ‘করিয়াছেন জীবনের ধ্রুবতারা’। এই মানুষটির জন্যে তাই বিশেষ প্রীতি, ভালোবাসা আর অতল শ্রদ্ধা!

এ দেশের অর্থনীতির প্রধান উৎস কৃষি এবং দেশের অন্তত সত্তর শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষির ওপর এখনও নির্ভরশীল। অথচ কৃষিপ্রধান এ দেশের অর্থনীতির অবহেলিত খাতগুলোর মধ্যে কৃষি নিজেই একটি। যুগোপযোগী কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন-বিতরণ-ব্যবহারের প্রবণতা স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এ দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়েনি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কৃষির যে পাঠ্যসূচি রয়েছে তা-ও ঠিক পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট আধুনিক – এমনটি জোর দিয়ে বলা যাবে না। কৃষি-অন্ত-প্রাণ এ দেশে কৃষিকে ঘিরে যে আয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মাধ্যমে আমাদের দেখার কথা ছিল, তা কেন যেন আমরা ঠিকভাবে দেখতে পাইনি। কিন্তু একান্ত দায়িত্ববোধের তাড়নায় যে ব্যক্তিটি সেই প্রায় শূন্যতা থেকে উত্তরণের মহান ব্রতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে চলেছেন, সেই কর্মবীর ব্যক্তিটি হলেন শাইখ সিরাজ।

নিছক উন্নয়ন বা কৃষি সাংবাদিকতা নয়, এর মাধ্যমে কোটি মানুষের প্রাণকে স্পর্শ করেছেন তিনি; মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন মাটির কাছে, হৃদয়ের টানে। সাংবাদিকতাকে শহরের অভিজাত ড্রয়িং রুম থেকে তিনি গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। শাইখ সিরাজ তাঁর টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষিজীবীদের জীবনধারা চিত্রিত করেছেন, তাঁদের প্রতিদিনকার সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনার কথা তুলে এনেছেন।

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘মাটি ও মানুষ’-এর যে যাত্রা তিনি শুরু করেন এর মাধ্যমে শুধু যে লাখো কৃষকের জীবন পাল্টেছে তা নয়, পাল্টেছে কৃষিতে অবহেলার চিরায়ত চিত্রও। পরে প্রাইভেট স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আই-এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষক, কৃষি ও গ্রামীণ জীবনযাত্রা নিয়ে সামগ্রিকভাবে দেশের কৃষিখাতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলোকে নজরে আনতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে এ দেশের গণমাধ্যমে কৃষি বিষয়ক প্রচারণার নতুন পথ রচনা করে চলেছেন তিনি; এরই পথ ধরে দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোতে এখন কৃষি বিষয়ক খবর গুরুত্ব পাচ্ছে; কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উদ্ভাবন, গ্রামীণ জীবনব্যবস্থা বিষয়ক খবর এখন নিয়মিত খবরের অংশ। কৃষিপণ্যকে শিল্পপণ্যে রূপ দেওয়া যে কৃষি অর্থনীতির জন্যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তা উপলব্ধি করে এ বিষয়েও দিনের পর দিন গণমাধ্যমে অ্যাডভোকেসি করেছেন তিনি। এভাবে গণমাধ্যমকে উন্নয়নমুখি করার ক্ষেত্রে এ অবদান অনেক বড়।

বাংলাদেশ টেলিভিশন হয়ে বর্তমানে চ্যানেল আই-এর সূত্র ধরে শাইখ সিরাজ নিয়মিতভাবে সফল কৃষক ও কৃষি সাফল্য, ফলন বৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষকের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, বাজার ব্যবস্থার সঙ্কট নিরূপণ ও সমাধানের পথনির্দেশ, কৃষি উপকরণের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি, মাটির স্বাস্থ্য, জৈব কৃষি, পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপট, গ্রাম পর্যায়ে অবকাঠামো সঙ্কট, উচ্চ মূল্যের কৃষিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ, কৃষকদের সংগঠিত করা, উন্নত দেশগুলোর কৃষি সফলতা ও সেরা অনুশীলনগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, বিভিন্ন দেশে বাঙালি কৃষি উদ্যোক্তাদের সাফল্য, দেশের কৃষিপণ্যগুলো রপ্তানির ক্ষেত্রে বাধাগুলো চিহ্নিত করা ও তা দূর করতে সরকারের নীতি পরিচালনা ও উদ্যোগগুলোর ওপর আলোকপাতসহ কৃষি-সংশ্লিষ্ট হেনো ইস্যু নেই যা নিয়ে তিনি অনুষ্ঠান করেননি। এর পাশাপাশি কৃষকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে তাদের অধিকার সচেতন করা ও রাষ্ট্রের নীতি পরিচালনার সঙ্গে তাদের বিষয়গুলো যুক্ত করার পেছনেও শাইখ সিরাজ অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। সংবাদে যেখানে কৃষিখাতই ছিলো উপেক্ষিত, সেখানে শাইখ সিরাজ কৃষককে দাঁড় করিয়েছেন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে; কৃষকের মুখ থেকেই তিনি তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করেছেন তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর চ্যালেঞ্জের কথা। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এটি রীতিমত বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর মাধ্যমে একদিকে শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন কৃষক, কৃষি ও গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে আগ্রহ ও জানা-শোনা বাড়লো, অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদে টেলিভিশন মিডিয়ার উপযোগ ও জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। শাইখ সিরাজ টেলিভিশনের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমের নগরকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতাকে ভেঙ্গে বিশাল পরিধিতে নিয়ে গেছেন। তার একের পর এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে টেলিভিশন আজ শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই সীমাবদ্ধ নেই, টেলিভিশন পরিণত হয়েছে সমাজ বদলের অন্যতম এক শক্তিতে।

 

কৃষি ও উন্নয়নমূলক টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও ইতিবাচক সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে শাইখ সিরাজ বাংলাদেশে উন্নয়ন সাংবাদিকতার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন; এর মাধ্যমে দেশের পল্লী উন্নয়ন, শ্রমজীবী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের মধ্য দিয়ে কৃষিপণ্যের জীবনকাল দীর্ঘস্থায়ীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধকরণ ও গবেষণাধর্মী প্রচার-প্রচারণার কাজ করে চলেছেন। বিশেষ করে আগামীর খাদ্য চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কার্যকর দিক নির্দেশনা বের করে আনতে ইতোমধ্যে তিনি কৃষিখাতে উন্নত দেশ চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন সফর করে সেখানকার কৃষি প্রযুক্তি ও সাফল্যের বার্তা পৌছে দিয়েছেন বাংলাদেশের তৃণমূল কৃষক পর্যায়ে।

 জীবন বৃত্তান্ত

শাইখ সিরাজ,  ১৯৫৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা: ওবায়দুল হক, ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রনালযের সিনিয়র সহকারী সচিব। মাতা- এরসাদুন্নেসা। গ্রাম/পোষ্ট: গন্ডামারা, থানা: হাইমচর, জেলা: চাঁদপুর। খিলগাঁও গভঃ হাইস্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটে তাঁর শিক্ষাজীবন। তিনি ভূগোলে সম্মানসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন।

শাইখ সিরাজ এর চার ভাই ও চার বোন। শাইখ সিরাজ চার ভায়ের মধে দ্বিতীয়। বড় ভাই সফিউল্লাহ্, আনসার এক্সিটেন্ট অফিসার। তৃতীয় ভাই শেখ নজরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ছোট ভাই শেখ নাজমুল হক মিরন , ইমপ্রেক্স মার্চেন্টাইজ ম্যানেজার।

বোন শিরিন বেগম, স্বামী বেসিকের ডিরেক্টর। হেলেনা বেগম, স্বামী আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় পার্টির সাবেক দপ্তর সম্পাদক। নার্গিস বেগম, স্বামী আমেরিকান প্রবাসি। রুজিনা বেগম, স্বামী ব্যবসায়ী।

স্ত্রী : সাহানা সিরাজ।

সন্তান : শাইখ সিরাজ  এর দুই ছেলে।

  • আয়ন, বি.এস.সি ইন্ঞ্জিনিয়ার আর্কিটেকচার।
  • বিজয়, এম.বি.এ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

বাবা-চাচা চার ভাই, ফুফু পাঁচ জন।

ফুফাত ভাই মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, গন্ডামারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মোঃ জসিম , চ্যানেল আই এর প্রশাসনিক অফিসার।

শিক্ষাজীবন

এস এস সি             ১৯৭২              খিলগাও গভ: উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা।

এইচ এস সি             ১৯৭৪             নটরডেম কলেজ, ঢাকা।

অনার্স                   ১৯৭৮            ভূগোল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মার্ষ্টাস                   ১৯৭৯            ভূগোল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কর্মজীবন

তিনি ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড চ্যানেল আই’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বার্তাপ্রধান। তার কৃষিবিষয়ক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় দেশের সব পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে কৃষিভিত্তিক কার্যক্রমের পরিধি বেড়েছে। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন এর মাটি ও মানুষ নামক টিভি প্রোগ্রামের জনপ্রিয় উপস্থাপকও কৃষি ব্যক্তিত্ব। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি ও বিভিন্ন উন্নত চাষ পদ্ধতি, কৃষি ব্যবস্থাপনা, বেকার ও শিক্ষিত যুবকদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করা হতো। তিনি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ নামে চ্যানেল আইতে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। চ্যানেল আইতে জাতীয় সংবাদে প্রতিদিনের কৃষি সংবাদ চালুর মধ্য দিয়ে তিনিই প্রথম দেশের গণমাধ্যমে কৃষিকে প্রাত্যহিক গুরুত্বের মধ্যে নিয়ে আসেন। এর ধারাবাহিকতায় চ্যানেল আইতে একটি পৃথক ও বিশেষ বুলেটিন আকারে প্রচার শুরু হয় কৃষি সংবাদ।

প্রকাশিত গ্রন্থ

  • মৎস্য ম্যানুয়েল,
  • মাটি ও মানুষের চাষবাস,
  • ফার্মার্স ফাইল,
  • মাটির কাছে মানুষের কাছে,
  • বাংলাদেশের কৃষি : প্রেক্ষাপট ২০০৮,
  • কৃষি ও গণমাধ্যম,
  • কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (সম্পাদিত),
  • আমার স্বপ্নের কৃষি,
  • কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (২০১১),
  • সমকালীন কৃষি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১১)

পুরস্কার

  • একুশে পদক (১৯৯৫)
  • জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এএইচ বুর্মা অ্যাওয়ার্ড (২০০৯)
  • বৃটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি অনার অ্যাওয়ার্ড
  • বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএ) পদক (২০১১)
  • স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮)

এছাড়া ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *