একজন সত্যিকারের ক্রিকেট যোদ্ধার গল্প
একজন সত্যিকারের ক্রিকেট যোদ্ধার গল্প, ৭ জানুয়ারি, ২০০৯।
পুরো সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড বিস্ময়ভরা চোখে,
দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালো একজন ১১ নম্বর ব্যাটসম্যানকে!
আগের ইনিংসে হাত ভেঙ্গে যে ওপেনার ‘অবসর’ নিয়েছিলেন,
সেই ওপেনার যখন পরের ইনিংসে ভাঙ্গা হাত (তাও আবার বটম হ্যান্ড) নিয়ে ১১ নম্বরে নামেন,
শুধু একটা টেস্ট ম্যাচ বাঁচাবেন বলে,
যেখানে সিরিজও আগেই জিতে নিয়েছিল তাঁর দল, বিস্মিত তো হতেই হয়!
‘এক’ হাতে ১৭ বল খেলে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছিলেন ম্যাচের ১০ বল বাকি থাকতে।
সে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াই জিতেছিল বটে,
কিন্তু সেই ব্যাটসম্যানের উপর ভর করে ক্রিকেটও কি জিতে নি এতটুকু?
গ্রায়েম স্মিথের ক্যারিয়ারটাই এমন বিস্ময়ে ভরা। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে এসে প্রথম তিন-অঙ্কের দেখা পেয়েছিলেন,
সেটি ছিল আবার ডাবল সেঞ্চুরি!
টেস্ট অভিষেকের এক বছরের মাথায় যখন দেশের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে অধিনায়কত্ব পেলেন মাত্র ২২ বছর বয়সে,
অনেকেই ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়েছিলেন।
ওয়েস্ট প্রভিন্সের এই তরুন অধিনায়কের দলে যে তখন ছিলেন পোলক, ক্যালিস, কার্স্টেন, গিবস, বাউচারদের মত অভিজ্ঞ নাম!
কার্স্টেন পরে যখন আফ্রিকার কোচ হয়ে এলেন, তখনো তাঁর দলের অধিনায়ক সেই স্মিথ!
ব্যাটিং স্ট্যান্স যদি চন্দরপলের ব্যাতিক্রমী হয়,
গ্রিপিং যদি হয় গিলির, তবে প্যাড পরার স্টাইলে স্মিথও আর সবার থেকে ব্যাতিক্রম।
নিরেট – সৌন্দর্য তাঁর ব্যাটিং এ সবসময় ছিল না,
তবে কার্যকরিতায় স্মিথ ছিলেন সবসময়।
ঐ ‘থলথলে’ বিশাল শরীর নিয়ে,
সাইড-অন স্টাইলের প্যাড পড়ে,
প্যাডের উপরের বলকে মিড-উইকেটে আর ড্রাইভ-লেংথের বলকে ইন-ফ্রন্ট-অব স্কয়ারের উপর দিয়ে বাউন্ডারি পাঠাতে খুব একটা ভুল হয়নি স্মিথের।
২০০৮ এ চট্টগ্রামে নিল ম্যাকেঞ্জিকে নিয়ে গড়েছিলেন ৪১৫ রানের উদ্বোধনী জুটি,
আজও যা রেকর্ড হিসেবে অক্ষুন্ন।
তবে ‘অধিনায়ক’ স্মিথ বোধহয় সবসময় ছাপিয়ে গিয়েছেন ‘ব্যাটসম্যান’ স্মিথকে।
যখন অকস্মাৎ বিদায় জানালেন সবরকম ক্রিকেটকে তখনও যেন চাপা পড়ে গেল টেস্টের ৪৫.১৯ গড়ের ৯২৬৫ রান, ৩৭.৯৮ গড়ের ৬৯৮৯ ওয়ানডে রান।
সামনে এসেছিল সেই স্মিথ,
যে স্মিথ অধিনায়কত্বের ভার সামলেছেন,
যে স্মিথ দঃ আফ্রিকাকে পুনর্গঠিত করছেন, বানিয়েছেন টেস্টের এক নম্বর দল,
যে স্মিথ টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশী ম্যাচ নেতৃত্ব দেয়া অধিনায়ক,
কমপক্ষে ৭০টি ম্যাচ নেতৃত্ব দেয়া অধিনায়কদের মধ্যে সাফল্যের হারে দ্বিতীয়।
স্কটিশ ফুটবলার কেনি ড্যালগিশকে হিরো মানা স্মিথ (লিভারপুল এফসির সমর্থক),
আইরিশ গায়িকা মরগান ডীনকে বিয়ে করেছিলেন ২০১১ তে,
অবসর নেয়ার পর ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে আবার। যাদের মিস করেন বলে ক্রিকেটকেই বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন,
সেই মেয়ে ক্যাডেন আর ছেলে কার্টার।
‘সাবেক’ স্ত্রীর দেশ আয়ারল্যান্ডের ‘নাগরিকত্ব’ও আছে তাঁর,
হয়তো পরিকল্পনা ছিল সেখানেই থিতু হওয়ার!
হয়তো আরো কয়েকবছর খেলা চালিয়ে যাবেন সারের হয়ে।
কিন্তু দঃ আফ্রিকা মিস করে যাবে তাদের ‘নেতা’কে, ক্রিকেট-বিশ্ব মিস করে যাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া একজন অধিনায়ককে।
অবসর নেয়ার বছরে বয়স ছিল মাত্র ৩৩,
কয়েকদিন ছিলেন কিছুটা অফ-ফর্মে,
তবে এরকম পরিস্থিতি থেকে আগেও অনেকবার বেরিয়ে এসে খেলেছেন অসাধারন সব ইনিংস,
ভক্তরা হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন সেরকম আরো একটা কামব্যাকের।
কিন্তু ঐ যে বিস্ময়!
স্মিথ তাই বিদায় বলে দিয়েছিলেন।
তবে ৪ মার্চ, ২০১৪-তে ঘরের ছেলেকে যখন পুরো নিউল্যান্ডস দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় শেষবারের মত, তখন অবশ্যই বিস্ময় থাকে না।
ক্রিকেট-বিশ্বের তরফ থেকে সেই সম্মানটুকু যে প্রাপ্যই ছিল সতীর্থদের আদুরে ‘বিফ’ এর!
দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভাল প্রদেশের জোহানেসবার্গে জন্মগ্রহণ করেন এই লিজেন্ডদারি ক্যাপ্টেন।