fbpx

‘মানুষ মারা যাওয়া কি হাসির বিষয়?’

গতকাল বুধবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে হেঁটে শাহবাগের দিকে যাওয়ার পথে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রথম দেখা পেলাম বাংলামোটর ট্রাফিক সিগন্যাল পার হওয়ার পর। সাদা হাফ হাতা শার্ট ও নীল প্যান্ট পরা ছেলেগুলোর ঘামে ভেজা চোখেমুখে দুপুরবেলার সূর্যের মতো গনগনে ক্রোধ; কিন্তু সেই ক্রোধ ওদের দিশেহারা করেনি। ওরা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে খুব ঠান্ডা মাথায়: ওরা প্রতিটা মোটরযান থামিয়ে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করে দেখছে।

বারডেম হাসপাতালের প্রথম ফটকের সামনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালনকারী তিন তরুণ ও এক তরুণীকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেলাম, ওরা ঢাকা সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওদের চলাচল দ্রুত, চোখের দৃষ্টি চঞ্চল, কিন্তু চোখমুখের অভিব্যক্তিতে দায়িত্বশীলতার ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ মনে হয়, ওরা যেন রাতারাতি কিশোর থেকে পূর্ণবয়স্ক মানুষ হয়ে উঠেছে: গোটা রাজধানীর পথঘাটের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে।

‘আপনারা সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন কেন?’ আমার জিজ্ঞাসায় ওরা ভ্রুক্ষেপ করল না; কিংবা শুনতেই পেল না। আমি একই প্রশ্ন আবার জিজ্ঞাসা করলাম। এবার একজন বিরূপ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। আমি বললাম, ‘আপনারা এটা কত দিন চালাবেন?’
‘যত দিন দাবি আদায় না হচ্ছে।’
‘আপনাদের দাবিগুলো কী?’
‘নয় দফা দাবি আছে।’
‘কী সেগুলো?’
‘মনে নাই। ওয়েবে পাবেন।’

শাহবাগ চত্বর স্লোগানে মুখর ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। ওখানে হাজারখানেক ছেলেমেয়ের জটলা জমে উঠেছে; প্রায় সবারই পরনে স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম। মেয়ের সংখ্যা অনেক। একটি মেয়ে মাইকে কথা বলছিল: সে সবাইকে বসার জন্য বারবার অনুরোধ করছিল। অনেকেই মাটিতে বসে পড়েছে; কেউ কেউ রাস্তায় সাদা কাগজ পেতে পোস্টার লিখছে। অধিকাংশ পোস্টারে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ। একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের রাগ কার ওপর বেশি, পুলিশের ওপর না ড্রাইভারদের ওপর?’
‘ড্রাইভারদের ওপর।’
‘তাহলে পুলিশের বিরুদ্ধেই বেশি পোস্টার কেন?’
‘কারণ পুলিশ আমাদের ওপর গুলি চালাইছে। আমরা তো রাজনীতি করি না। আমরা আমাদের বন্ধুদের হত্যার বিচার চাই। পুলিশ আমাদের ওপরে গুলি চালাল কেন?’
একটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের দাবিগুলো কী?’
‘শাজাহান খানের পদত্যাগ চাই।’
‘কেন?’
‘সে হাসল কেন? মানুষ মারা যাওয়া কি হাসির বিষয়? তার কি ছেলেমেয়ে নাই?’
পাশ থেকে একটি ছেলে বলল, ‘শাজাহান খানকে ভালোভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। তারপর পদত্যাগ করতে হবে। সে পদত্যাগ না করলে তাকে বের করে দিতে হবে।’ এর মধ্যে কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে আমাকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল: ‘স্যার আসছে। এই, স্যাররে কিছু বলতে বলো।’

ওরা ভেবেছে আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ওদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাতে এসেছি। একটি ছেলে আমার কাছে এসে বলল, ‘স্যার, আপনি মাইকে কিছু বলেন। এরা আপনার কথা শুনবে। আমাদের কথা তো শুনতেছে না। দেখেন, কত বলতেছি, আপনারা বসেন, বসেন, বসতেছে না।’

কী স্বতঃস্ফূর্ত সারল্য! খুব ভালোভাবে বোঝা যায়, তাদের এই সমাবেশ সংগঠিত কিছু নয়, সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে একান্তই হৃদয়ের ভাবাবেগতাড়িত হয়ে তারা ছুটে এসেছে বন্ধু-সহপাঠীর ‘হত্যা’র প্রতিকার চাইতে। ওদের সমবেত কণ্ঠে স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না। আমার বোনের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’

আমি ওদের বললাম, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নই, একজন সংবাদকর্মী।’ আমি ওদের পরামর্শ দিলাম, ‘আপনারা আপনাদের দাবিগুলো একটা একটা পড়ে মাইকে শোনান।’ ওরা কিছুক্ষণ পর সেটাই শুরু করল। ওদের এক নম্বর দাবি হলো, ওদের দুই বন্ধু-সহপাঠীর ঘাতক বাসচালকের ফাঁসি। দুই নম্বর দাবি, নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ। তার পরের দাবিগুলো নাগরিক সমাজে বহুল উচ্চারিত: যেমন ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সে যানবাহন চালানো বন্ধ করা, পদচারী পারাপারে আন্ডারপাস, পদচারী-সেতু ইত্যাদির ব্যবহার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

একটি ছেলে অতি উচ্চকণ্ঠে ‘জ্বালো জ্বালো’ স্লোগান ধরল। শাজাহান খানের গদিতে আগুন জ্বালানোর দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে শাহবাগ চত্বর ফেটে পড়ল। এই আগুন জ্বালানোর স্লোগান মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে মাইক্রোফোনটি প্রায় কেড়ে নিল অন্য এক তরুণ। সে ডাক দিল ন্যায়বিচারের: উই ওয়ান্ট জাস্টিস। এই স্লোগান আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য রকম মনে হলো। এই স্লোগানে এতকালের জ্বালাও-পোড়াওয়ের সুর নেই। এর ছন্দও অন্য রকমের।

কিছুক্ষণ পর সাদা অ্যাপ্রোন পরা বেশ কিছু তরুণ-তরুণীর আগমন ঘটল; তাদের পেয়ে সমাবেশে যেন নতুন প্রাণের আবেগ সঞ্চারিত হলো। ন্যায়বিচারের দাবিতে উচ্চকিত হয়ে উঠল হাজার তরুণ-তরুণীর কণ্ঠস্বর। মাইকে ঘোষণা করা হলো, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এসেছে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাতে। ওদের মধ্য থেকে একজন মাইকে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করল, ‘আমাদের প্রত্যেকের, কারও না কারও ভাই, বোন, বাবা, মায়ের মৃত্যু হচ্ছে রাস্তায়। এই অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না।’

বিভিন্ন দিক থেকে শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দিচ্ছে; সমাবেশের আকার ক্রমেই আরও বড় হচ্ছে। একসময় দেখতে পেলাম বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানার নিয়ে পনেরো-কুড়িজনের একটি দল এসে সমাবেশে যোগ দিল। তবে তাদের পক্ষ থেকে মাইকে কাউকে বক্তৃতা করতে দেখা গেল না। আরও কিছু সময় পর বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ব্যানার ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের একটা কুশপুত্তলিকা নিয়ে টিএসসির দিক থেকে এগিয়ে এল ছোট একটা দল। তারা এসে মূল সমাবেশের জায়গায় জড়ো হতেই মাইকে ঘোষণা দিয়ে পোড়ানো হলো সেই কুশপুত্তলিকা।

আরও পরে মাইকে শুনতে পেলাম এক শিক্ষার্থীর মায়ের কণ্ঠ, ‘সড়কে আমার একটা সন্তানেরও মৃত্যু দেখতে চাই না। আপনারা এখন কীভাবে করবেন আমি জানি না, কিন্তু সড়কে মৃত্যু বন্ধ করতেই হবে।’

বেলা দুইটা পর্যন্ত শাহবাগ চত্বরে সমবেত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, অন্তত নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ কিংবা বরখাস্তের ঘোষণা না শুনে তারা ঘরে ফিরে যাবে না।

ভ্রাম্যমাণ পানি বিক্রেতা, ফলের দোকানি, পান-সিগারেট বিক্রেতা, হাসপাতালে চিকিৎসারত স্বজনকে দেখতে আসা মানুষসহ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি, এই যে ছেলেমেয়েরা রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করছে, এতে তাঁরা বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন কি না। একজনকেও পাইনি, যিনি বিরক্তি বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এক বৃদ্ধ সিগারেট বিক্রেতার মন্তব্য, ‘হেরা ঠিকই করতেছে। মুন্ত্রী…এর মতন হাসে ক্যা? বাচ্চা পুলাপানগুলার জীবনের দাম নাই?’
এই মন্ত্রীকে যত দ্রুত বিদায় দেওয়া হবে ততই মঙ্গল।

https://currentbdnews24.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *