ফরিদী ভাই
আমাকে অজানা কারণে ‘পাগলা’ বলে ডাকতেন ফরিদী ভাই
‘পাগলা’ বলে ডাকতেন ফরিদী ভাই
আমাকে অজানা কারণে ‘পাগলা’ বলে ডাকতেন ফরিদী ভাই। ফরিদী মানে, হুমায়ুন ফরিদী—দ্য পারফর্মিং জিনিয়াস। বুম বুম নায়ক, মিষ্টি হাসির খলনায়ক। অভিনয়ে তার হাজারো মাত্রা। এমন এক অভিনেতা, যে কোন চরিত্রে মানিয়ে যায়। কবি? হবে। ডাকাত? হবে। নবাব সিরাজউদ্দউলা? হবে। লর্ড ক্লাইভ? হবে। ডাক্তার, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, চোর সব-ই হবে। আমি তাঁকে চোর হতে অনুরোধ করলাম। আমার নাটক ‘দুই প্রহরের প্রহরী’তে। স্ক্রিপ্ট পড়ে মহা খুশি। হেসে বললেন, ‘এইটা তো চোর না পাগলা, এইটা তো আমি!’ চোর হলেও চরিত্রটি ক্ল্যাসিক ছিল।
ফরিদী ভাইয়ের এক্সপ্রেশন ভিন জগতের। ডায়ালগে ডায়ালগে তার পেশি খেলে। শুটিং হবে আশুলিয়ার এক গ্রামে। শুনে বললেন, ‘অই পাগলা, আমারে নিয়া আউটডোরে শুটিং করলে কিন্তু ভিড় সামলাইতে পারবা না।’ পাত্তা দিলাম না। বললাম, ‘আপনে ওইটা নিয়া ভাইবেন না। ডোন্ট ওরি।’ আমাদের মধ্যে এই ভাষাতেই কথা হতো।
আউটডোর শুটিংয়ে গিয়ে চোখ ছানাবড়া। এই ভিড় তো জলকামান ছাড়া সরানো যাবে না। এরই মধ্যে হয়েছে আশপাশের গার্মেন্টসের লাঞ্চ ব্রেক। এবার যোগ হয়েছে পোশাক কর্মীরা। বিশাল জনস্রোত। আড় চোখে ফরিদী ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনিও তাকিয়ে ছিলেন। চোখাচোখি হতেই অন্যদিকে তাকিয়ে বিজয়ের মুচকি হাসি দিলেন। আমিও হারতে নারাজ। ক্যামেরাম্যান তপন ভাইকে বললাম, শুটিং চলবে। মেগাফোনে (হাতে ধরা মাইক) চিৎকার করে বললাম, ‘আপনে ডায়ালগ দ্যান ফরিদী ভাই, অডিও পরে নিব। ফাইভ-ফোর-থ্রি-টু-ওয়ান-জিরো-অ্যাকশন!’
শুটিংয়ের সময় আমার আচরণ সিরিয়াস ডিক্টেটরের মতো। সব শিল্পীর সঙ্গে আমার আচরণ একই রকম। কেয়ার করি না, কে কী ভাবল। পারফেকশনটা আমার কাছে জরুরি। শুটিংয়ের পর আবার ফ্রেন্ডলি। বিষয়টা মার্ক করলেন ফরিদী ভাই। প্রত্যেক দৃশ্যের পর পাশে এসে পিঠে হাত রেখে বলেন, ‘পাগলা, আমার অভিনয় ঠিক আছে তো?’ আমি মুচকি হাসি। আমি লেখক। আমি জানি এর অর্থ। ফরিদী ভাই সস্নেহে টিজ করছেন আমাকে। বোঝাচ্ছেন, তুমি যদি উত্তর কোরিয়ার স্বৈরাচার কিম জং হও, আমিও কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প!
একটা মজার দৃশ্য। অভিনেতা খলিলুল্লাহ খান ও ফরিদী ভাই। ডায়ালগের পর মিউট এক্সপ্রেশন দিতে হবে। ফরিদী ভাইকে চিৎকার করে বলছি, ‘ফরিদী ভাই, ডানে তাকান, দূরে আকাশে! একটু দুশ্চিন্তা, যেন ওই চিলটা ছোঁ মারবে আপনার চোখে! এইবার আড় চোখে খলিল আংকেলের দিকে তাকান। আবার উপরে। আ-স্তে! এইবার আস্তে আস্তে নিচে, লজ্জিত। চিন ডাউন রাখেন। আস্তে আস্তে ক্যামেরায় লুক দেন! হোল্ড! আই বল বাঁয়ে ঘোরান! এইবার ডানে! আবার ক্যামেরায়! আপনার বাঁকা হাসিটা দ্যান! কা-ট! ওকে শট!’
আকাশ ফাটিয়ে হো হো করে হেসে ফরিদী ভাই ইউনিটের সবাইকে চিৎকার করে বললেন, ‘অই মিয়ারা! দিনটা লেইখা রাখো। পাগলা আজকে হুমায়ুন ফরিদীরে অভিনয় শিখাইসে!’ পাত্তা দিলাম না। জানি তিনি কী মিন করেছেন।
ফরিদী ভাইয়ের সঙ্গে আমার কাজের চেয়ে বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক ছিল বেশি। অবসর হলেই ফোন করে বাসায় আড্ডা দিতে ডাকতেন। কিন্তু মুশকিল করত তার এক আদরের কুকুর। এমনিতেই কুকুর আমি ভয় পাই। তার উপর এমন বিদঘুটে কুকুর জীবনে দেখি নাই। মাত্র ইঞ্চি দশেক লম্বা, পেট মোটা। কলিং বেলে দরজা খুললেই বিশ্রী ঘেউ ঘেউয়ে তেড়ে আসে। ফরিদী ভাই আদর করে ওটাকে স্লিভলেস জামা পরিয়ে রাখেন। ভেবে দেখেন। একজনের ঘরে ঢুকছেন, কয়েক ইঞ্চি লম্বা পেট মোটা বিদঘুটে এক কুকুর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আপনার দিকে তেড়ে আসছে। পরনে মেয়েলি আবেদনময়ী স্লিভলেস জামা! ফরিদী ভাইকে নালিশ করায় বললেন, ‘আরে ধ্যুর মিয়া। খুব দামি কুত্তা।’ জাতটার নাম বলেছিলেন। মনে নেই। খাবার দাবার খুব পছন্দ ফরিদী ভাইয়ের, আমারও। কিন্তু আমার খাবারকে সব সময় অন্য খাবার দিয়ে উড়িয়ে দেবেন। যদি বলি, ‘মুরগির কলিজা চাবাইতে মজা।’ তাহলে বলবেন, ‘ধ্যুর মিয়া, হাঁসের কইলজা বেশি মজা।’ এ রকম আর কি!
ফরিদী ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘আজকে বাংলাদেশ জিতবে।’ বললেন, ‘বাজি লাগবা?’ বললাম, ‘লাগব, কত টাকা?’ বললেন, ‘এক লাখ?’ বললাম, ‘ওইটা আপনেও দেবেন না, আমিও দেব না। কাজের কথায় আসেন। বিশ হাজার।’ বললেন, ‘সই। ক্যাশ দিবা কিন্তু।’ বললাম, ‘ডান, আপনিও ক্যাশ দিয়েন!’
রাতে অলৌকিকভাবে সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিলো বাংলাদেশ। অলি-গলি থেকে রাজপথে মিছিলের পর মিছিল আসতে লাগল, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ-বাংলাদেশ! ফরিদী ভাইকে ফোন দিয়ে দেখি ফোন বন্ধ।
নাহ। বাজি হারার ভয়ে ফোন বন্ধ রাখার মানুষ ফরিদী ভাই না। অনেক রাত। হয়তো ঘুমিয়ে গেছেন।
আজ হুমায়ূন ফরিদী ভাইয়ের জন্মদিন। হুমায়ূন ফরিদীরা একশ বছরে একজন আসে। এ দেশকে বহু দশক অপেক্ষা করতে হবে আরেক হুমায়ূন ফরিদী পেতে। যেমন অপেক্ষা করছে হলিউড আরেকজন গ্রেগরি পেক পেতে।
ফরিদী ভাই, আপনি শান্তিতে ঘুমান। আই মিস ইউ বিগ ব্রাদার। ইউ আর দ্য গ্রেগরি পেক অব বাংলাদেশ। আমি সার্টিফিকেট দিচ্ছি। মাই নেইম ইজ খান!
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ!