ধর্ষণ কেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ? জানুন
কুমিল্লার তনু থেকে বগুড়ার রূপা। শিশু রিশা থেকে দুই মারমা সহোদরা। একের পর এক ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর খুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে, যার সর্বশেষ শিকার হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের বিউটি আক্তার। বিউটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। কেন ঘটছে এসব ঘটনা? নারীর প্রতি এ সহিংসতার প্রতিকার কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার হচ্ছে না অপরাধীদের। বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে নারীকেই। আর যেকোন ধর্ষণ বা সহিংসতার পেছনেই সমাজের বেশিরভাগের আগ্রহ নারীর দোষ খোঁজার ক্ষেত্রে, যা ধর্ষণকে আরও উৎসাহিত করে তুলছে।
তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা প্রতিকারের ক্ষেত্রে প্রথমত নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে আগে কঠোরভাবে আমলে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত তাৎক্ষণিকভাবে এমন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়। এর পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব ধর্ষকদের পরিবারসহ সামাজিকভাবে বয়কট করা।
যে কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা
নারীর প্রতি সম্মান কমে যাওয়া এবং নারীকে শুধু পণ্য নয়, ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতাই নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: আগে নারীকে জানার সুযোগ কম ছিলো। কিন্তু এখন শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি বাড়ায় তাদেরকে জানার সুযোগ আরও বেড়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি সম্মান বাড়ার কথা ছিলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে উল্টো আরও কমেছে।
‘বিজ্ঞাপনের ভাষায় আমরা বলতাম নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি তার থেকেও খারাপ হয়েছে। অনেকে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। যা নারীর প্রতি সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এ সহযোগী অধ্যাপক মনে করেন, একটি ছেলে ধর্ষক হয়ে ওঠার পেছনে দায় আছে তার পরিবারেরও। পরিবার যদি তাদের কন্যা সন্তানদেরকে মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান দেয়, তবে ছেলে সন্তানরাও সেটা দেখে নারীদের সম্মান দিতে শেখে।
‘কিন্তু আমাদের সমাজের পরিবারগুলো কন্যা সন্তানদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে না। তাই ছেলে সন্তানেরা নারীকে পণ্য হিসেবেই ভাবতে শেখে।’
এ বিষয়ে প্রায় একই মনোভাব পোষন করেন আরেক জেন্ডার বিশেষজ্ঞ তানিয়া হক। তিনি মনে করেন, একটা ছেলে ধর্ষক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে তার পরিবারেরও অনেক ভূমিকা থাকে। তাই ধর্ষকের সঙ্গে উচিত তাদের পরিবারকেও শাস্তির আওতায় আনা।
‘আগে একটা নির্দিষ্ট বয়সী নারীদের নিয়ে আমাদের ভয় ছিলো। এছাড়া রাত নারীর জন্য নিরাপদ নয় এমন একটা ধারণা প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন বয়স এবং সময়ের পার্থক্য ঘুচে যাচ্ছে। দিন নেই রাত নেই, তিন বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউ নিস্তার পাচ্ছে না ধর্ষকদের কাছ থেকে।’
শাস্তির ভয় না থাকার কারণেই ধর্ষকরা সাহসী উঠছে এবং একের পর এক সহিংসতা ঘটিয়ে চলেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের এ সহযোগী অধ্যাপকের মতে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় জেন্ডার স্টাডিজের ঘাটতিও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী এসব সহিংসতার জন্য।
প্রতিকার কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করা। বিচারের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যেন ভবিষ্যতে কেউ আর এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।
সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী বলেন: রাষ্ট্রের উচিত কঠোরভাবে আইন প্রণয়ন করে তার দ্রুত প্রয়োগ ঘটানো। সাইবার বুলিং থেকে শুরু করে যেকোন টিজিংয়ের যদি শক্তভাবে বিচার করা হয়, তবে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।
‘আমাদের যেখানে কঠোর আইন থাকার কথা সেখানে নেই। মেয়েদের সাইবার হয়রানি থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজন আরও কঠোর আইন।’’
তাছাড়া ধর্মকেও ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের পরামর্শ তার। তিনি বলেন: ‘প্রতিটি ধর্মেই নারীকে সম্মান করার কথা বলা হয়েছে। তাই ধর্মের ইতিবাচক দিকগুলো বেশি বেশি প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
তানিয়া হক মনে করেন, এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাৎক্ষণিক এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। তিনি বলেন: সরকার পারে না এমন কিছু নেই। তাই সরকার যদি শক্তভাবে আইন প্রণয়ন করে এবং শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাহলে এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা কমে আসবে।
তারা দু’জনই মনে করেন, বছরে যদি ১০টা ঘটনারও কঠোর শাস্তি তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায় তবে একটা বার্তা পৌঁছাবে সমাজে। যা নারীদের হয়রানি রোধে সহায়ক হবে। পাশাপাশি ধর্ষক এবং তার পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে অন্য পরিবারগুলোও একটা বার্তা পাবে। তখন প্রতিটি পরিবারই ছেলে সন্তানদেরকে নারীদের প্রতি সম্মান দেওয়ার শিক্ষার ব্যবস্থা করবে।