শরীরে অতিরিক্ত পানি জমার কারণ ও করণীয়
হঠাৎ শরীরে অতিরিক্ত পানি জমার কারণ ও করণীয়
শরীর ফুলে গেছে’, ‘শরীরে পানি জমেছে’ বা ‘মুখ ফুলে গেছে’—এ রকম সমস্যা নিয়ে অনেকে চিন্তিত।
নানা কারণে শরীরে পানি জমতে পারে। ফুলে যেতে পারে পা, হাত, মুখমণ্ডল ।চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় শরীরের পানি আসার নাম হলো ইডিমা।
ইডিমা মানে শরীরে অস্বাভাবিক এবং অতিরিক্ত জলীয় অংশ জমে যাওয়া। সাধারণত পায়ে বা মুখে প্রথম এ লক্ষণ দেখা দিলেও পানি জমতে পারে পেটে বা বুকেও।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে সতর্ক হতে হবে। শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অঙ্গ তথা হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি, খাদ্যনালির কাজের ব্যাঘাত ঘটলে পা ও শরীরে পানি আসে। শরীর ও পায়ে পানি আসার কিছু কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ।
হৃৎপিণ্ডের সমস্যা : হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা কমে গেলে, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত (IHD), হৃদযন্ত্রের ভাল্বের সমস্যায় হার্টের মাংসপেশির কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে পা, পেট, বুকে পানি আসে। রোগীর বুকব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ থাকে।
লিভারের সমস্যা : লিভার সিরোসিস হলে প্রথমে পেট, পরে পা ও বুকে পানি জমে। হেপাটাইটিস ভাইরাস (বি, সি), অতিরিক্ত মদ্যপান, লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমে লিভারের সিরোসিস হয়। রোগীর খাবারে অরুচি, হলুদ প্রস্রাব, রক্তবমির লক্ষণ থাকে।
কিডনির সমস্যা : নেফ্রোটিক সিনড্রোম, নেফ্রাইটিস ও কিডনি বিকল হলে প্রথমে মুখ, পরে পা ও বুকে পানি আসে। এসব রোগীর বেশি বেশি প্রস্রাব, বমি বমি ভাব, খাবারে অরুচি, প্রস্রাব ফেনা ফেনা, প্রস্রাবের রঙ ঘন সরিষার তেলের মতো, কম প্রস্রাব হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকে। রক্তে আমিষের মাত্রা কমে গেলে, পরিমিত খাবার না খেলে, হজম না হলে, খাদ্যনালি থেকে আমিষ বের হয়ে গেলে, কিডনি দিয়ে আমিষ বেরিয়ে গেলে, আমিষ শরীরে তৈরি না হলে রক্তে আমিষের মাত্রা কমে যায়। রক্তে আমিষ কমে গেলে পা, পেট ও বুকে পানি আসে।
থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা : শরীরে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে গেলে পায়ে পানি আসে। রোগীর গলগ-, শীত লাগা, মোটা হয়ে যাওয়া, মাসিকের সময় রক্ত বেশি যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকে।
ওষুধের কারণে পা ফুলে যাওয়া : ব্যথার ওষুধÑ ডাইক্লোফেনাক, ন্যাপরোক্সেন, আইবুপ্রফেন, ইটোরিকক্সিব খেলে পায়ে পানি আসে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, ক্যালসিয়াম, চ্যানেল ব্লকারÑ নিফেডিপিন, অ্যামলোডিপিন সেবনে পানি আসতে পারে।
পায়ে পানি এলে করণীয় :
১। বিপরীত জলচিকিৎসা
আপনার পায়ের পাতার ফোলা কমানোর জন্য অনেক কার্যকরী একটি পদ্ধতি হচ্ছে ঠান্ডা ও গরম পানির থেরাপি। যেখানে গরম পানি রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে আর ঠাণ্ডা পানি ফোলা ও জ্বালাপোড়া কমতে সাহায্য করে। এই প্রকার জল চিকিৎসার জন্য ২টি বালতি বা গামলার প্রয়োজন হবে।
- একটিতে ঠান্ডা পানি ও অন্যটিতে গরম পানি নিন
- গরম পানির বালতিতে আপনার পা ৩-৪ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন।
- তারপর আপনার চরণযুগল গরম পানি থেকে উঠিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে ১ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন।
- এভাবে পর্যায়ক্রমে ১৫-২০ মিনিট করুন
- দিনে কয়েকবার এই প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করুন যতক্ষণ না আপনার পায়ের ফোলার উপশম হয়।
২। মালিশ করা
পা ফুলে যাওয়ার সমস্যার প্রতিকারে পা মালিশ করা সবচেয়ে ভালো উপায়। এটা আক্রান্ত স্থানে চাপ প্রয়োগ করে কঠিন মাংসপেশিকে শিথিল বা ঢিলা হতে সাহায্য করে এবং রক্ত চলাচলের উন্নতি ঘটায়। এছাড়াও অতিরিক্ত তরল নিষ্কাশনকে প্রণোদিত করে ফোলা কমায়।
- সরিষার তেল বা অলিভ অয়েল সামান্য গরম করে আক্রান্ত স্থানে মালিশ করুন
- পায়ের পাতার নীচ থেকে উপরের দিকে উঠিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করুন। খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করবেন না।
- এভাবে দিনে কয়েকবার করুন।
- গোসলের সময় বা গোসলের পরে মালিশ করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৩। পা উত্তোলন
যেহেতু পানি জমে থাকার কারণে পা ফুলে যায় তাই এই পানিকে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করলে এই সমস্যাটি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এজন্য আপনার ফুলে যাওয়া পা দুটো উপরের দিকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
- আপনার পা দুটো এমন উচ্চতায় রাখুন যাতে হার্ট থেকে উপরের দিকে থাকে
- এর ফলে পায়ে আবদ্ধ পানি নিষ্কাশিত হতে পারবে এবং পা ফোলা কমবে।
- দিনে ৪-৫ বার এভাবে করুন এবং প্রতিবার এক ঘন্টা করে রাখুন।
৪। লেবু পানি
লেবু পানি খেলে শরীরের অতিরিক্ত তরল ও বিষাক্ত পদার্থ বাহির হয়ে যায় যা পা ফোলা কমতেও সাহায্য করে। এটা শরীর কে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে এবং এর প্রদাহরোধী উপকারিতাও আছে।
- ২ টেবিল চামচ লেবুর রস ১ কাপ উষ্ণ গরম পানিতে মিশান
- সামান্য মধু মিশিয়ে মিষ্টি স্বাদ করে নিতে পারেন
- দিনে কয়েক বার এই পানীয়টি পান করুন
৫। টি ট্রি অয়েল
ফোলা কমাতে টি ট্রি অয়েল চমৎকার কাজ করে। অন্য এসেনশিয়াল অয়েলের মত টি ট্রি অয়েল পাতলা করার প্রয়োজন হয়না। এটি সরাসরি ত্বকে ব্যবহার করা যায়।
৬। স্বাস্থ্যকর খাবার
শরীরের সঠিক কার্যকারিতার জন্য লবনের প্রয়োজন আছে কিন্তু অতিরিক্ত লবণ শরীরে পানি জমতে সাহায্য করে। তাই অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ বর্জন করতে হবে। ক্যাফেইনকেও একই অপরাধে অভিযুক্ত করা যায়। তাই কফি গ্রহণের মাত্রাও সীমিত করা প্রয়োজন।
যদি আপনার পা ফোলার সমস্যাটি প্রায়ই হয়ে থাকে এবং সেই সাথে ব্যথাও থাকে তাহলে একজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। কারণ এটি অন্য কোন স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে যার জন্য সময়মত চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন।