মেসি-রোনালদোর জোড়া-স্বপ্ন খুন হওয়ার রাত
এমনটা ঘটবে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করছে!
বিশ্বকাপের একই রাতে বিদায় ঘটল বিশ্বের সেরা দু্ই ফুটবলার লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এমনটা ঘটবে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করছে! ছবি দুটো একই। শুধু জার্সি আর মানুষ আলাদা। তবে কষ্টের রংটা বোধ হয় আলাদা নয়। যে কষ্ট নিয়ে নিয়ে তাঁরা বিদায় নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ থেকে, তা আরও ঘনীভূত হলো তাঁদের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপেও। বিশ্বকাপটাই যে জেতা হলো না! এই মুহূর্তে বিশ্ব-সংসারের দুই সেরা ফুটবলারকে তাই মাঠ ছাড়তে হলো নতমস্তকে।
ক্লাব ফুটবলে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন চলে না। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে প্রশ্নটা রয়েই গেল। এই রাত (বাংলাদেশ সময়) তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সেই প্রশ্নবোধক চিহৃটাই যেন খুঁচিয়ে বের করল! ভক্তদের কাছে তাঁর জবাব থেকেও এখন নেই। ফাইনাল দূরে থাক, সেমি কিংবা কোয়ার্টারও নয় শেষ ষোলো থেকে বিদায়, সেটাও আবার একই রাতে। অলক্ষ্যে বসে এই চিত্রনাট্য লিখেছেন কে! রাতটা তাই ফুটবলপ্রেমীদের ভোলার কথা নয়। বিশেষ করে মেসি-রোনালদোর ভক্তদের জন্য এই রাত শোকের মোহনায় একীভূত হওয়ার।
যেখানে তাঁদের কষ্টকে একসূত্রে গেঁথে রাখবে একটি পরিসংখ্যান—বিশ্বকাপের নকআউটপর্বে প্রজন্মের সেরা এই দুই খেলোয়াড়ের গোলসংখ্যা। শূন্য! বিশ্বকাপের এই হারলেই বিদায়ের মঞ্চে রোনালদো খেলেছেন ৬ ম্যাচ, মেসি ৮ ম্যাচ। এর মধ্যে রোনালদো নিয়েছেন ২৫ শট, মেসি তাঁর চেয়ে দুটি শট কম নিয়েছেন। কিন্তু কেউ জাল খুঁজে পাননি। আজও তাই ঘটল। আর তাই দুজনের ছবিটাই থাকল একইরকম। আর্মব্যান্ড খুলতে খুলতে মাঠ ছাড়ছেন বর্তমানের দুই বিশ্বসেরা।
পেছনে পড়ে রইল কত গৌরবগাথা, কত অর্জন আর কত পুরস্কার। কিন্তু আসল অর্জনটাই তো নেই—বিশ্বকাপ জয়ের পদক। অথচ, বিশ্বকাপের মঞ্চে এ নিয়ে রোনালদো আসলেন চারবার, মেসিও সম সংখ্যকবার। তবে নির্মম ‘অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স’-এর শিকার হওয়ার রাতেও প্রচণ্ড আশাবাদী ভক্তরা বলতে পারেন, কেন কাতার বিশ্বকাপ আছে তো? বটে! ২০২২ বিশ্বকাপ আসতে আসতে রোনালদো ৩৭ আর মেসি ৩৫। এই বয়সেও খেলা চলে। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণও আছে। তবে ওই বয়সে মেসি-রোনালদো কতটুকু ছন্দে থাকবেন সেই প্রশ্নটা এখনই রাখা যায়।
দেখা গেল, তখন দুজনেই খেলছেন কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়ায় সুযোগ পেলেন না বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। এই ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে আগেই বিদায় বলে দেওয়াই তো ভালো? রোনালদো আপাতত এ নিয়ে মুখ খোলার মতো অবস্থায় নেই। ম্যাচ শেষে সেটাই বুঝিয়ে দিলেন, ‘এখন খেলোয়াড় ও কোচদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার সময় নয়।’ মেসি রাশিয়ায় পা রাখার আগেই বলে রেখেছেন, ‘আমরা কেমন খেলি ও কীভাবে শেষ করি তার ওপর নির্ভর করছে।’
যদিও এরই মাঝে একবার বলেছিলেন, বিশ্বকাপ না জিততে না পারলেও জাতীয় দলের হয়ে খেলা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু শেষ ষোলো থেকে ছিটকে পড়ার পর আর্জেন্টাইন ফুটবল যে উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যাবে তার মাঝে মেসির মন টিকবে? প্রিয় সতীর্থের কথা ভেবে তাই বাকি সবার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন হাভিয়ের মাচেরানো। শেষ ষোলো থেকে ছিটকে পড়ার পরই জাতীয় দল থেকে অবসর ঘোষণা করা মাচেরানোর আশা, ‘মেসি জাতীয় দলের সঙ্গে থেকে যাবে বলে আশা করছি। তাঁকে এখন একা থাকতে দেওয়াই ভালো।
যেদিন সে অবসর নেবে সেদিন আমরা বুঝব সে কত বড় মাপের খেলোয়াড় ছিল!’ মেসির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদোর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এই পর্তুগাল শেষ ষোলোয় উঠেছে রোনালদোয় ভর করে। পর্তুগালের ছয় গোলের চারটিই যে তাঁর। দলটির কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোসের তাই দাবি, ‘ক্রিস্টিয়ানোর এখনো ফুটবলকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে। আশা করি সে দলের সঙ্গে থেকে তরুণদের বেড়ে ওঠায় সাহায্য করবে।’
কিন্তু সমস্যা হলো এসব কথা তাঁদের ঘিরে বাকিদের আশার বুনট। তাতে মেসি-রোনালদোর কষ্ট এতটুকু লাঘব হয় না। জাতীয় দলের হয়ে দুজনেই সর্বস্ব নিংড়ে দেন, দুজনেই জান বাজি রেখে খেলেন। কিন্তু এই রাতে কি এক ভানুমতির খেলে দুজনেই মিলে গেলেন সেই পরিচিত বিন্দুতে—বিশ্বকাপে ব্যর্থ। এই জ্বালা তাঁদের চেয়ে ভালো আর কে বোঝে!
আর তাই মেসি-রোনালদোকেই বুঝে নিতে হবে তাঁদের পরবর্তী পথটুকু। সেই পথের কোথায় যতি টানতে হবে তা দুজনকেই মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছে এই রাতটা। শুধু কি রাত?