ভুল চিকিৎসা কি গাছে ধরে?
ডা. মো. মাকসুদ উল্যাহ্ঃ চট্টগ্রামে শিশু মৃত্যুর ঘটনাকে ডাক্তার কর্তৃক খুন আখ্যা দিয়ে মানুষ বিভিন্ন পাবলিক পোস্টে যেভাবে ডাক্তারদেরকে গালিগালাজ করতেছে, সেটার নিন্দা জানানোর মতো কোনো ভাষা আমি জানি না! একজন মুমিন-মুসলিমের উচিত, নিজে কী বলতেছি, কী করতেছি; সেটা একটু ফিরে দেখা। পুনর্বিবেচনা করা! তারা যা করতেছে, তা মুসলিম সমাজের জন্য শোভনীয় নয়।
কেউ কেউ নিজের মতো করে ডাক্তারি শেখাতে চাচ্ছে সবাইকে! ডাক্তার খুনী, এ কথাটা সভ্য সমাজের মানুষের মুখে মানানসই নয়। কেননা ডাক্তার কখনো খুন করার জন্য চিকিৎসা করে না।
বরং একজন ডাক্তার সবসময় চায় তার চিকিৎসায় রোগী দ্রুত সেরে উঠুক। এতে করে তার সুনাম সুখ্যাতি বাড়বে! একই কারনে সে কখনোই চাইবে না, তার দ্বারা কোনো ভুল চিকিৎসা হোক এবং সে কারনে রোগীর কোনো বড় ক্ষতি হোক। কেননা এতে তার পেশাগত সুনাম নষ্ট হবে! তারও ক্ষতি হবে! মানুষ কখনোই একটু ভালো করে ভেবে দেখে না। বাস্তবতা হচ্ছে রোগীর অবস্থা যদি শুরু থেকেই মরনাপন্ন থাকে, তবে সঠিক চিকিৎসা দিলেও রোগী মারা যাবে।
আর কোনো ওষুধ প্রয়োগ করার পর রোগীর নতুন কোনো উপসর্গ বা লক্ষন দেখা দিলে বা অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার মানেই এই নয় যে, সেটা ওই ওষুধের কারনে হয়েছে। রোগের নিজের গতিপ্রকৃতির অংশ হিসেবেও নতুন উপসর্গ বা লক্ষন দেখা দিতে পারে এবং অবস্থা খারাপ হয়ে মারা যেতে পারে। কিন্তু এসব পরিস্থিতিতেই নিয়মিত প্রভাবশালী লোকেরা তাৎক্ষনিকভাবে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে ডাক্তারকে শারীরিক বা মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করতেছে! অথবা ডাক্তারকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! তদন্তে ভুল প্রমাণিত হলে তিনি ন্যায্য ক্ষতিপূরন দিবেন।
তদন্ত করে যখন দেখা যাবে ডাক্তার সঠিক চিকিউসাই দিয়েছিলেন, তখন কিভাবে তার ক্ষতিপূরন হবে? মুসলিম হশে মানুষ যে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর! সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে, লোকেরা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করে নিজের ধারনার ভিত্তিতে! আর তাদের ধারনা সব সময়ই অবাস্তব, কেননা তারা ডাক্তার নয়! ডাক্তার অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করতে পারে। কিন্তু সেটা তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হলেই তাকে তিরষ্কার করা যাবে! ক্ষতিপূরন আদায় করা যাবে।
কিন্তু দোষ প্রমাণের আগে ডাক্তারকে লাঞ্ছিত বা হাজতে যেতে হবে কেন? মারে ডাক্তার, রাখে কে? নউজুবিল্লাহ! এ ধরনের কথা উচ্চারন করা পরিষ্কার শিরক! ডাক্তারের প্রতি অন্ধ ঝাল ঝাড়তে গিয়ে মানুষ কত বড় বড় পাপ করতেছে, তা একবারও ভেবে দেখে না! একজন যুবক একটি বাজারে যাওয়ার পথে কিছু লোক তাকে ধরে চোর সাব্যস্ত করলো। চোর চোর বলেলে চিৎকার দিতে থাকলো! দেখা গেল চিৎকার চেঁচামেচি শুনে অন্য আরো অনেক লোক এসে তাকে মারতে মারতে এক সময় যুবকটির মৃত্যু হলো! অথচ কেউ একবারের জন্য প্রথমে উপস্থিত লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলো না, কী কারনে আপনারা তাকে চোর বলছেন? সে কী চুরি করেছে? চুরি করা সেই জিনিসটাইবা কই? পরে জানা গেল যুবকটি চোর ছিল না! আল কুররআনে সুরা হুজরাতে ৬ নং আয়াতে আছে, কোনো ফাসেক লোক যদি তোমার কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে, তা তুমি যাচাই করো।
কেননা অন্যথা তোমার দ্বারা অপরাধ হতে পারে, যে কারনে পরে তুমি লজ্জিত হতে পারো! চট্টগ্রামেও ডাক্তারের সাথে এমন আচরনই করা হয়েছে! হাসপাতালে প্রায়ই ওষুধ প্রয়োগের পর পান থেকে চুন খসলেই রোগীরা সেটাকে রিঅ্যাকশন হিসেবে ভেবে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে! খুব খারাপ লাগে তখন! সবাই মনে করে ডাক্তার মানে অনেক টাকা! তাই ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা করেও তারা যখন ডাক্তার হতে পারে না, তখন তারা এ ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকে! কিন্তু সভ্য সমাজে কি এগুলো মেনে নেয়া যায়? আপনাদের এ ধরনের মন্তব্যের জন্য আল্লাহর কাছে কি জবাবদীহি করতে হবে না?
লেখকঃ চিকিৎসক, ঢাকা মেডিক্যল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।