খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর নকল বাবা-ছেলের কাহিনী।
ব্যাংকের চোখে ধুলা দিল নকল বাবা-ছেলে
নকল বাবা-ছেলে সেজে ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ নেন তারা
পুরান ঢাকার লালবাগের ব্যবসায়ী আবদুল আলীমের দোকান থেকে ভবন নির্মাণ সামগ্রী কিনতেন মারগুব উদ্দিন আহমেদ। এভাবে কেনাকাটার সূত্রে তার কাছে ৩৫ লাখ টাকা পাওনা হয় ব্যবসায়ীর। দীর্ঘদিনেও টাকা পরিশোধ না করায় দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। একপর্যায়ে মারগুব এক অভিনব প্রস্তাব দেন। আবদুল আলীমও তাতে সম্মত হন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাবা-ছেলে সেজে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ নেন তারা। এরপর সেই টাকা সমান ভাগ করেন নকল বাবা-ছেলে দু’জনে। কিন্তু পরে ঋণ পরিশোধ না করে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন আবদুল আলীম। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর কাহিনী।তদন্তে বাবা-ছেলে সেজে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছেঃপুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মহানগর অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডের বনানী শাখায় এ প্রতারণার ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির সহকারী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাদী হয়ে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত করে পিবিআই। তদন্তে বাবা-ছেলে সেজে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আবদুল আলীম ও মারগুব উদ্দিন আহমেদ এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের বনানী শাখায় উপস্থিত হয়ে নিজেদের বাবা ও ছেলে হিসেবে পরিচয় দেন। এ সময় আবদুল আলীম জানান, লামিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে তার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঋণ নিতে চান তিনি। এক্ষেত্রে জামানত হিসেবে মতিঝিলের একটি ভবনের দুই হাজার ৩০০ বর্গফুট আকারের দুটি তলার মালিকানার দলিল উপস্থাপন করেন। তার কথিত বাবা মারগুব উদ্দিন আহমেদ হেবা দলিল করে ছেলেকে ওই দুটি তলা দিয়েছেন বলেও জানান। এরপর ব্যাংক সম্পত্তির মালিকানার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সব কাগজপত্রসহ ওই হেবা দলিল প্যানেল আইনজীবীদের কাছে পাঠায়। এরই মধ্যে আবদুল আলীম সংশ্নিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে একটি এনইসি উপস্থাপন করেন।
ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ করে দেন
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডের বনানী শাখার তখনকার ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ সিদ্দিকী পুলিশকে জানান, ব্যাংকের আইনজীবীরা খোঁজ নিয়ে উপস্থাপিত কাগজপত্র ঠিক আছে বলে প্রতিবেদন দেন। এর ভিত্তিতে ওই সম্পত্তি জামানত হিসেবে নিয়ে এক কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরের কয়েক মাসে দেখা যায়, আবদুল আলীম ঋণ পরিশোধে চরম গড়িমসি করছেন। একপর্যায়ে তিনি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ করে দেন। ফলে ব্যাংক তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে শুরু করে। এর মধ্যে মশিউর রহমান নামে জনৈক ব্যক্তির একটি চিঠির সূত্রে জানা যায়, আবদুল আলীম ও মারগুব উদ্দিন প্রকৃতপক্ষে বাবা-ছেলে নন।মামলার এজাহারে বাদী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ উল্লেখ করেন, ঋণের টাকা আদায়ে আবদুল আলীমের দেওয়া ঠিকানায় বারবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এতে ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। এরপর অনুসন্ধানে নেমে দেখা যায়, জামানত হিসেবে সম্পত্তি বন্ধক দেওয়ার প্রক্রিয়ায় বড় জালিয়াতি করা হয়েছে।মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর এসআই ফরিদ উদ্দিন সমকালকে জানান, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্যে হেবা দলিলটি তৈরি করা হয়।
ঋণের টাকা তোলার পর আবার সেই দলিল বাতিল করেন কথিত বাবা মারগুব উদ্দিন আহমেদ। তাদের প্রকৃত জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে দেখা যায়, বাবা-ছেলে তো দূরের কথা, দু’জনের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্কও নেই। আবদুল আলীমের বাবা প্রয়াত আমান আলী, মা মরিয়ম বেগম। লালবাগের হরনাথ ঘোষ রোডে তাদের বাসা। শুধু পাওনা টাকা পরিশোধের কৌশল হিসেবে তারা বাবা-ছেলে পরিচয়ে পরস্পরের যোগসাজশে এই প্রতারণার আশ্রয় নেন। চুক্তি অনুযায়ী ঋণের টাকা তারা দু’জনে ৫০ লাখ করে নেন। হেবা দলিল তৈরি, জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম-ঠিকানা পরিবর্তন ও বাবা-ছেলে পরিচয়ে জাল দলিল ব্যবহার করে ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে তারা দণ্ডবিধির ৪৬৭, ৪৬৮ ও ৪৭১/৩৪ ধারার অপরাধ করেছেন। এ কারণে সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে আদালতে।