ক্ষতিপূরণ
এক পায়ের ক্ষতিপূরণ মাত্র ৮০ হাজার টাকা!
মাত্র ৮০ হাজার টাকা!
২৮ বছরের তরুণ টিটু বড়ূয়া। এখন বয়স নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু তিনি দাঁড়াবেন কী করে, তার তো পা-ই নেই। তবে জন্মসূত্রে পঙ্গু নন এ তরুণ। কিছুদিন আগেও তার সুস্থ সবল দুটি পা ছিল আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো। গত ৫ এপ্রিল নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকের চাপায় ঊরু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় টিটুর বাঁ পা। এক পা হারিয়ে ট্রাক মালিকের কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন টিটুর অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাওয়া ৮০ হাজার টাকা চট্টগ্রামে এক সপ্তাহের চিকিৎসায় শেষ হয়ে গেছে। অবস্থার অবনতি হলে ৫ মে বিএসএমএমইউতে আনা হয়। ড্রেসিং, কেবিন ভাড়া, রক্ত ও ওষুধ বাবদ প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকা খরচ হয় তার চিকিৎসায়। প্রতিদিন রক্ত দিতে হয়।
শিগগির অস্ত্রোপচার করতে হবে পায়ের কাটা জায়গায়। কৃত্রিম পা লাগাতে হবে। এর জন্য দরকার কয়েক লাখ টাকা। কিন্তু এত টাকা ব্যয় করার সামর্থ্য নেই টিটুর পরিবারের।
বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক কৃষ্ণপ্রিয় দাসের অধীনে চিকিৎসাধীন টিটু। কৃষ্ণপ্রিয় বলেন, টিটুর অবস্থা স্থিতিশীল হলেও এখনও শঙ্কামুক্ত নন। পা হারানো ছাড়াও টিটুর শরীরের একটি অংশের চামড়া উঠে এসেছে। তা সারাতে অস্ত্রোপচার করতে হবে।
গত সোমবার টিটুর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানালেন, ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের আকবর শাহ মোড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চালকের ডান পাশে বসে ছিলেন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অটোরিকশাটি। নিয়ন্ত্রণ হারানো চালকহীন ট্রাক (চট্ট মেট্রো-ট-১১-১৭৮৯) পেছন থেকে অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অটোরিকশা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান টিটু। তার বাঁ পায়ের ওপর দিয়ে যায় ট্রাকটি। এরপর আর কী ঘটেছে মনে নেই টিটুর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে জ্ঞান ফিরে দেখেন এক পা নেই।
টিটু বড়ূয়ার বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। তার বাবা সুবিমল বড়ূয়া খৈয়াছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সুবিমল ও শিখা রানী বড়ূয়া দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট টিটু। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। টিটুই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের একমাত্র অবলম্বন। এইসএসসি পাস টিটু চট্টগ্রাম ইপিজেডে আজিম গ্রুপে চাকরি করতেন। পা হারানোর কারণে তিনি আবার চাকরিতে ফিরতে পারবেন কি-না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
হাসপাতালে টিটুর শয্যা পাশে কথা হয় তার মা শিখা রানী বড়ূয়া ও বোন শর্মী বড়ূয়ার সঙ্গে। কান্নায় বারবার কথা আটকে যাচ্ছিল শিখা রানীর। তাই প্রশ্নের উত্তরগুলো শর্মী বড়ূয়াই দিলেন। তিনি জানালেন, টিটুকে চাপা দেওয়া ট্রাকটির ব্রেক ফেল ছিল। চালক চলতি ট্রাক থেকে নেমে যান। নিয়ন্ত্রণ হারানো চলন্ত ট্রাক টিটুকে চাপা দিয়ে রাস্তার পাশে একটি বাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়।
শর্মী বড়ূয়া জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তারা আকবর শাহ মোড়ে যান। টিটুকে চাপ দেওয়া ট্রাকটিতে আটহাজার ইট ছিল। পাশ থেকে বিড়বিড় করে টিটু বড়ূয়া বলেন, ৫০ টনের ট্রাক পায়ের ওপর দিয়ে গেলে মানুষ বাঁচে? কেমনে বেঁচে গেলাম।
এক পা বিচ্ছিন্ন হলেও মামলা করেনি টিটুর পরিবার। তার বাবা সুবিমল বড়ূয়া বলেন, মামলা চালানোর মতো সামর্থ্য তাদের নেই। পুলিশ তাদের বলেছে, মামলা করে ক্ষতিপূরণ পেতে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে ‘নগদ যা পাওয়া যায়’ তাই নিয়ে নেওয়া ভালো। ট্রাক মালিকের নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি সুবিমল বড়ূয়া। তিনি জানান, স্থানীয় পরিবহন নেতা জাহাঙ্গীর আলম এবং আকবর শাহ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির হোসেন ডেকে নিয়ে তাকে ৮০ হাজার টাকা দেন। এর বেশি দিতে মালিকপক্ষ রাজি নয়। তারা বলেন, ‘৮০ হাজার নিলে নাও, নইলে এক টাকাও পাবে না।’ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির চট্টগ্রাম বন্দরবিষয়ক সম্পাদক সহিদুর রহমান টিপু সমকালকে জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় পর্যায়ে নেতা। কয়েকবার চেষ্টা করে এসআই জাকিরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আকবর শাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, তিনি চলতি মাসে থানায় যোগ দিয়েছেন। এপ্রিল মাসের ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানেন না। তিনি বলেন, আগে কী হয়েছে জানি না, তবে টিটু বড়ূয়া বা তার পরিবার যদি এখনও মামলা করে চায়, মামলা নেওয়া হবে।
ওসি আরও বলেন, বাস্তবতা হলো সড়ক দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার মামলা করতে চায় না। মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় বা বিচার পাওয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। তাই অনেকেই পরিবহন মালিকের সঙ্গে আপস করে ফেলেন। পুলিশ তাতে সহায়তাকারী বা মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করে মাত্র।