ইয়াবার 'চাচা-ভাতিজা'
ইয়াবার ‘চাচা-ভাতিজা’
চাচা-ভাতিজা
চাচা মো. শহীদুল্লাহ (৩৩) আর ভাতিজা হাফেজ মাহমুদ (২৫) দু’জনই কোরআনে হাফেজ। শহীদুল্লাহ আবার রাঙ্গুনিয়ার একটি মসজিদের ইমাম। চাচা-ভাতিজার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। দেশে ১২ বছর দাওরায় পড়ে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় যান তিনি। সেখানে কারিয়ানা পড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসেন ২০১৫ সালে। এরপর ইমামতি শুরু করেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ফেরিঘাট জামে মসজিদে। এ বাবদ তিনি মাসে আয় করতেন ৯ হাজার টাকা।
শহীদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু টেকনাফের বাসিন্দা ট্রাকচালক আলমগীর। ইমামতি করার সময় তার মাধ্যমে হঠাৎ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। আলমগীরের মালিকানাধীন ট্রাকের চেচিসের ভেতরে বিশেষ কৌশলে টেকনাফ থেকে ঢাকায় মাসে চালান আনতেন অন্তত ৬টি। এতে তার আয় হতো প্রায় এক লাখ টাকা।
লোভে পড়ে যান শহীদুল্লাহ। ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে ফেলেন ভাতিজা হাফেজ মাহমুদকে। চাচা-ভাতিজা মিলে যে কৌশল ব্যবহার করে টেকনাফ থেকে ঢাকায় ইয়াবা নিয়ে আসতেন, তারপর খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিতেন, কল্পনাকে হার মানায় তা।
ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান জানান, ট্রাকের চেচিসের ভেতরে আলমগীর টেকনাফ থেকে ইয়াবা তুলে দিয়ে চালকের পাশের সিটে বসিয়ে দিতেন তার বন্ধু হাফেজ শহীদুল্লাহকে। তার বেশভূষা দেখে বিন্দুমাত্র কারও সন্দেহের উদ্রেক হতো না। শ্মশ্রুমণ্ডিত শহীদুল্লাহর পরনে থাকত ধবধবে সাদা রঙের লম্বা পাঞ্জাবি, মাথায় সফেদ টুপি। প্রতিবার টেকনাফ থেকে ইয়াবাভর্তি ট্রাক এসে থামত যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়ার বিভিন্ন মসজিদসংলগ্ন জায়গায়। আগে থেকে ঢাকা, গাজীপুর, বরিশাল, মাদারীপুরের খুচরা ইয়াবা ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকত তাদের। পরিকল্পনামাফিক শহীদুল্লাহ যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়ায় নেমে পড়তেন, তার কাছে থাকা ছোট্ট শপিং ব্যাগের ভেতরে ইয়াবা নিয়ে ঢুকে পড়তেন মসজিদে। খুচরা ব্যবসায়ীরা ওই এলাকায় পৌঁছা পর্যন্ত ওখানেই নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন তিনি। এরপর একে একে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে হাতবদল করতেন ইয়াবার চালান। গত সোমবার যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে শহীদুল্লাহসহ আরও সাতজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
শহীদুল্লাহ গোয়েন্দাদের জানান, প্রতি হাজার পিস ইয়াবা ঢাকায় পার্টির কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিনিময়ে তিনি পেতেন ৫ হাজার টাকা। তবে এ ব্যবসার পুরোটা দেখভাল করতেন তার বন্ধু আলমগীর। ভালো লাভ দেখে সঙ্গে নিয়ে নেন ভাতিজা হাফেজ মাহমুদকে। তবে চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরা থানাধীন পশ্চিম হাজিনগর লেক এলাকা থেকে দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ ধরা পড়েন ভাতিজা। তখন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মাহমুদ জানান, ওই ইয়াবা টেকনাফের শহীদুল্লাহর। তবে তার পরিচয় বিস্তারিত জানেন না বলে দাবি করেছিলেন তিনি। ওই মামলায় শহীদুল্লাহকে আসামি করা হলেও তার ঠিকানা ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে লেখা হয়। তবে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে আসল পরিচয়- শহীদুল্লাহ আর হাফেজ মাহমুদ আপন চাচা-ভাতিজা।
জিজ্ঞাসাবাদে শহীদুল্লাহ জানান, ভারতের দেওবন্দে পড়াশোনা করতে যাওয়ার সময় তার বন্ধু আলমগীর অর্থ সহায়তা করেছিল তাকে। আলমগীরের কারণেই ভিসা ছাড়া তিনি ভারতে গিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পান। দেশে ফেরার পর আলমগীর তাকে ইয়াবা ব্যবসার প্রস্তাব দিলে সাড়া না দিয়ে পারেননি তিনি। তবে ইয়াবা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ার কথা জানতে পেরে মনোমালিন্য হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে। এরপরও অর্থলোভে চালিয়ে যান এই ব্যবসা।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা পুলিশের হাতে ৫ হাজার ইয়াবাসহ ধরা পড়েছিলেন শহীদুল্লাহ। এক বছর কারাগারে থাকার পর ২০১৭ সালের শেষের দিকে মুক্তি পান তিনি। কারাবন্দি থাকার সময় জেলের মধ্যে কয়েদি ও বন্দিদের নিয়ে নামাজ পড়তেন তিনি। জেল থেকে বের হওয়ার পর আবার যোগ দেন রাঙ্গুনিয়ার জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে। এরপরই আবারও জড়ান ইয়াবা ব্যবসায়।
এক বছর পর আবার কীভাবে একই মাদ্রাসায় ইমাম হিসেবে যোগ দিলেন- এমন প্রশ্নে শহীদুল্লাহ বলেন, জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মসজিদে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে তিনি জানান, এক বছর পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। তার জেলে যাওয়ার বিষয়টি জানতেন না তারা। তাই আবার ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।
জানা গেছে, শহীদুল্লাহর বাবার নাম আবদুল হালীম। আর মা ধলা বিবি। তারা পাঁচ ভাই ও সাত বোন। তার আরও তিন ভাই, এক বোন ও চার ভাতিজা কোরআনে হাফেজ। তাদের আর কাউকে শহীদুল্লাহ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়েছেন কি-না তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে শহীদুল্লাহ চক্রের যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা হলো স্বপন দত্ত (৩২), মাহবুর সরদার (৩০), মাহমুদ হোসেন (৩০), ইসমাইল হোসেন (৪৭), কালা হাসান (৪৫) ও বরকত আলী (৩৫)। তাদের হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৬ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট। মাদক পরিবহনে ব্যবহূত একটি মিনি ট্রাকও জব্দ করেছে পুলিশ। খোঁজা হচ্ছে এই চক্রের মূল হোতা আলমগীরকে।
ডিবি উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, শহীদুল্লাহ গ্রেফতারের পরপরই দোষ স্বীকার করেছেন। ইসলামে মাদক ব্যবসার কোনো স্থান নেই বলেও জানান তিনি। আর একবার সুযোগ পেলে ভালো পথে ফিরে আসবেন- জানান এটাও। তবে তার কথায় পুরোপুরি আস্থা পাচ্ছেন না তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা।