১০২টি সম্ভাব্য করোনা ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
মহামারী কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে ১০২টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন (প্রতিষেধক) তৈরির কাজ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তাদের ওয়েবসাইটে এই তথ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি নথি প্রকাশ করেছে।
স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের এই সংস্থা বলছে, বিশ্বজুড়ে গবেষণাধীন সম্ভাব্য এই ১০২টি ভ্যাকসিনের মধ্যে ৮টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের (গবেষণাগারে পরীক্ষার) অনুমোদন পেয়েছে। চারদিন আগেও এই সংখ্যা ছিল ৭টি। নতুন করে যুক্ত হয়েছে চীনে গবেষণাধীন একটি সম্ভ্যাব্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন।
প্রথম ৭টি ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ (হিউম্যান ট্রায়াল) করা হয়েছে। নতুন করে নথিভূক্ত হওয়া চীনের ওই ভ্যাকসিন এখনও মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা তা সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি হু।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন পাওয়া ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে চারটি চীনের। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে একটি করে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। অপরটি যৌথভাবে তৈরির কাজ করছে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বায়োটেক কোম্পানি।
গত ১৬ মার্চ প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের সম্ভ্যাব্য ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ করে দ্য আমেরিকান ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট বা এনআইএস। সেই ভ্যাকসিন এখনও পরীক্ষা-নিরিক্ষার সব ধাপ অতিক্রম করেনি।
এরপর একে একে আরও ৬ টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা বায়োটেক কোম্পানি তাদের তৈরি কোভিড-১৯ এর সম্ভ্যাব্য ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ করেছে। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরিক্ষা শেষে কার্যকরীতার প্রমাণ পাওয়া গেলে তা বাজারে আসবে।
কোভিড-১৯ কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনও তৈরির ঘোষণা দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বিদ্যমান ওষুধ প্রয়োগ করে করোনা রোগীদের সুস্থ করা যায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা করছেন। কেউ ফ্লুর ওষুধ, কেউ ম্যালেরিয়ার ওষুধ প্রয়োগে সফলতা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তবে রেমডেসিভির করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগারে রেমদেসিভির নামের একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আশার আলো দেখাচ্ছে। মার্কিন বায়োফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা গ্লিড সায়েন্সেসের তৈরি এ ওষুধ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষাতেও সফল হয়েছে বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এমনটি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি এবং সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অ্যান্থনি স্টিফেন ফাউসি।
স্থানীয় সময় বুধবার হোয়াইট হাউসে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ-এর তত্ত্বাবধানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১০৬৩ মানুষের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক।
তিনি জানান, তাদের বেশির ভাগের মধ্যে রেমডেসিভির দেয়া হয়েছিল। অন্যদের প্লেসেবো (ভুয়া ওষুধ) দেয়া হয়। তাতে দেখা গেছে রেমডেসিভির গ্রহণকারীরা গড়ে ১১ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে প্লেসেবো গ্রহণকারীদের সুস্থ হতে সময় লেগেছে গড়ে ১৫ দিন।
তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এক বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, করোনা আক্রান্তদের শরীরে রেমডেসিভির দেয়ার পরে দেখা গেছে অন্যদের তুলনায় কম সময়ের মধ্যে তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে এই ওষুধ মৃত্যুহার কমাতে পারবে কিনা, তা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
ডা. ফাউসি বলেন, সব তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দেখা যায় যে, রেমিডেসিভির প্রয়োগের ফলে করোনা আক্রান্ত রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব করোনা আক্রান্ত রোগী রেমডেসিভির গ্রহণ করেছে তাদের মৃত্যুহার ৮ শতাংশ ছিল কিন্তু যারা প্লেসেবো নিয়েছে সেখানে তাদের মৃত্যুহার ছিল ১১.৬ শতাংশ। তবে এটি দ্বারা প্রমাণিত নয় যে রেমডেসিভির মৃত্যুহার কমায়।
ফাউসি বলেন, এখন থেকে প্রমাণিত হলো যে আমরা করোনা চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যে কোনও একটি ওষুধ ব্যবহার করতে পারবো। বর্তমানে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য কোনো অনুমোদিত ওষুধ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কার্যকর ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছে। এরই একটি হলো রেমডেসিভির। গিলিড সায়েন্সেস-এর তৈরি এ ওষুধটি অতীতে ইবোলার বিরুদ্ধে পরীক্ষা করা হলেও তেমন সফলতা মেলেনি।
তবে বিভিন্ন সময়ে পশুর শরীরে চালানো বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, সার্স ও মার্স-এর মতো করোনা প্রজাতির ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় এ ওষুধ কার্যকর হতে পারে। তাই এবার করোনা প্রজাতির নতুন ভাইরাস কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের চিকিৎসায় রেমডেসিভির কার্যকর কিনা তা নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ পরীক্ষা চালাচ্ছে।
এদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও কোভিড-১৯ এ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের ওপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগে অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের তৈরি করা টিকা বানরের দেহে প্রয়োগ করে সফলতা মিলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হ্যামিলটনের রকি মাউন্টেন ল্যাবরেটরিজের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ৬ টি বানরের ওপর প্রথমে টিকাটি প্রয়োগ করা হয়। এরপর সেগুলোর দেহে ব্যাপক মাত্রায় কোভিড-১৯ ভাইরাস ঢোকানো হয়। ২৮ দিন পর দেখা গেছে বানরগুলো পুরোপুরি সুস্থ আছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই টিকাটি উৎপাদনের দায়িত্ব পেয়েছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। এই কোম্পানিটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
সিরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যেই এই টিকা বাজারে আনতে পারবে তারা। সবকিছু ঠিক থাকলে ভারতের পুনে শহরের দু’টি কারখানায় টিকা তৈরির কাজ শুরু হবে। আগামী বছরের মধ্যে ৪০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। উৎপাদিত টিকার বাজার মূল্য হবে এক হাজার রুপি।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার টিকা বানরের দেহে সফল প্রয়োগের খবর পাওয়ার পরপরই সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা টিকা উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেহেতু বানরের ওপর টিকাটি কাজ করেছে, সেহেতু মানষের ওপরও তা কাজ করবে বলে আশাবাদী তিনি।
পুনাওয়ালা বলেন, অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা ছিল বলেই তাদের সঙ্গে এ কাজে যুক্ত হয়েছি। আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঝুঁকি তো নিতেই হয়।
আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের তৈরি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফল পাওয়া যাবে। আর তা সফল হবে বলে মনে করেন পুনাওয়ালা।
অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, টিকাটি কাজ করছে কিনা শুধু এটুকু দেখাই যথেষ্ট নয়। বরং তাতে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা অথবা ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে কিনা তাও দেখতে হবে।সেজন্য একটু সময় লেগে যাবে।
সূত্র: সিএনএন।