আবিস্কারের পরে কি দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ টিকা পাবে?
বিশ্বজুড়ে এই মূহুর্তে করোনাভাইরাসের টিকা আবিস্কারের জন্য মোট ৪৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের যেসব দল এই কাজে নিয়োজিত কেইট ব্রোডেরিক তাদের একটি দলের সদস্য। তিনি একজন অনুজীব জিন বিজ্ঞানী।
কেইট ব্রোডেরিক কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ইনোভিওতে। এই কোম্পানিটি আশা করছে এ বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ তারা কোভিড-নাইনটিনের টিকার দশ লাখ ডোজ তৈরি করতে পারবে। কিন্তু এই টিকা কোথায় পাওয়া যাবে, কাদের দেয়া হবে?
ডক্টর ব্রোডেরিকের মনে এই প্রশ্ন মাঝেমধ্যেই উঁকি দিচ্ছে। স্কটল্যান্ড এর এই বিজ্ঞানীর এক বোন কাজ করেন বৃটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএসের একজন নার্স হিসেবে।
“আমার বোন প্রতিদিন রীতিমত লড়াই করছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সাহায্য করার জন্য। সুতরাং আমি অবশ্যই চিন্তিত এই টিকা আসলে কারা পাবে এবং সবার কপালে এটি জুটবে কীনা। এই টিকাটা আমাদের তৈরি করে রাখতেই হবে।”
টিকার মজুতদারি
ইনোভিওর মত কোম্পানি যে টিকা তৈরি করার চেষ্টা করছে সেসব টিকা ধনী দেশগুলো মজুতদারী করার চেষ্টা করবে কিনা এখনই সেরকম একটা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
যেসব বিশেষজ্ঞ এরকম উদ্বেগের কথা বলছেন তাদের একজন এপিডেমিওলজিস্ট সেথ বার্কলি। একটা ইমিউনাইজেশন গ্যাপ বা টিকা নিয়ে বৈষম্য তৈরি হতে পারে বলে আশংকা করছেন তিনি।
সেথ বার্কলি হচ্ছেন দ্য ভ্যাক্সিন অ্যালায়েন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী। এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে বিশ্বের দরিদ্রতম ৭৩টি দেশের মানুষের কাছে টিকার সুবিধা পৌঁছে দেয়ার জন্য। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান।
“করোনাভাইরাসের টিকা হয়তো এখনো তৈরি হয়নি কিন্তু এসব বিষয়ে আমাদের এখনই কথাবার্তা বলা দরকার”- বলছেন ডক্টর বার্কলি।
“আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে ধনী দেশগুলোতে যাদের টিকা দরকার তাদের জন্য তো বটেই, গরীব দেশগুলোতেও যাদের টিকা দরকার তাদের জন্যও যথেষ্ট পরিমাণে টিকা তৈরি করা।”
“আমি অবশ্যই চিন্তিত। দুস্প্রাপ্য জিনিস নিয়ে বাজে কাজ সবসময়ই হয়েছে। এখানে আমাদের অবশ্যই সঠিক কাজটা করতে হবে”- বলছেন ডক্টর বার্কলি।
তার এই আশঙ্কা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। এর আগের অনেক টিকার ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। সম্প্রতি একটি জার্মান সংবাদপত্র একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে একটি খবর দিয়েছিল যাতে বলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি টিকা কেবলমাত্র মার্কিনিদের জন্য কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
এই টিকাটি তৈরি করছিল জার্মান বায়োটেকনোলজি কোম্পানি কিউরভ্যাক।
হেপাটাইটিস বি টিকা নিয়ে বৈষম্য
টিকার ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের সবচাইতে বড় উদাহরণ হচ্ছে হেপাটাইটিস-বি টিকা। বিশ্ব লিভার বা যকৃতের ক্যান্সারেরর সবচেয়ে বড় কারণ হেপাটাইটিস-বি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এটি এইচআইভির চেয়ে ৫০ গুণ বেশি সংক্রামক।
২০১৫ সালে বিশ্বে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি ৭০ লাখ।
১৯৮২ সালে ধনীদেশগুলোতে এই ভাইরাসের টিকা চলে আসে। কিন্তু ২০০০ সাল পর্যন্ত গরীব দেশগুলোর দশ শতাংশের কম মানুষকে এই টিকা দেয়া গেছে।
টিকার এই বৈষম্য দূর করতে কাজ করছে ‘গ্যাভি’ বলে একটি সংস্থা। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস এটি গড়ে তুলেছেন। টিকাদানের ক্ষেত্রে যে মারাত্মক বৈষম্য, সেটি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে পেরেছেন তারা। কারণ বিশ্বের বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আর বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে পেরেছেন তারা এটি নিয়ে।
এক্ষেত্রে বড় কাজ করছে এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন্স। ২০১৭ সালে নরওয়ে ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছিল সরকারী এবং বেসরকারি অনুদান থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবহার করে টিকা উদ্ভাবন করার লক্ষ্যে।
এই প্রতিষ্ঠানটি সব টিকা সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পক্ষে।
এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, “কোভিড-নাইনটিন প্রমাণ করে দিয়েছে যে সংক্রামক ব্যাধি রাজনৈতিক সীমানা মানে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত না করছি ততক্ষণ আমরা একটা সংক্রামক ব্যাধির বৈশ্বিক হুমকি মোকাবেলা করতে পারবো না।
দুধরণের বাস্তবতা
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি আসলে দুধরণের।
একটা উদাহারণ হচ্ছে গারডাসিল বলে একটি টিকা। মার্কিন ল্যাবরেটরি মেরেক এটি উদ্ভাবন করে ২০০৭ সালে। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) মোকাবেলায় তৈরি টিকাটি মার্কিন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পায় ২০১৪ সালে।
বিশ্বে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের (জরায়ুমুখ ক্যান্সার) জন্য মূলত দায়ী এই এইচপিভি। কিন্তু বিশ্বের স্বল্পোন্নত মাত্র ১৯টি দেশে এই এইচপিভির টিকা পাওয়া যায়। অথচ বিশ্ব জরায়ুমুখ ক্যান্সারে যত মৃত্যু ঘটে, তার ৮৫ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশে।
কেন এই সংকট? সেটা বুঝতে হলে আমাদের টিকা নিয়ে যে বাণিজ্য চলে বিশ্বজুড়ে, সেটা জানতে হবে।
টিকা থেকে মুনাফা
ঔষধ কোম্পানিগুলোর নিত্যদিনের যে ব্যবসা-বাণিজ্য, টিকা তার প্রধান অংশ নয়। বিশ্বের ঔষধের বাজার প্রায় ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের (২০১৮ সালের পরিসংখ্যান)। এর মধ্যে টিকা কেনা-বেচা হয় মাত্র ৪০ বিলিয়ন ডলারের।
ঔষধ তৈরির চেয়ে টিকা তৈরির আর্থিক ঝুঁকি কেন বেশি, সেটা এই পরিসংখ্যান থেকেই পরিস্কার বোঝা যায়।
টিকার গবেষণা এবং তারপর সেটি তৈরি করা বেশ খরচ সাপেক্ষ। আর টিকা বাজারে ছাড়ার আগে এটি নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়, সেটির নিয়ম-কানুন বেশ কড়া।
আর সরকারি খাতের যেসব সংস্থা ঔষধ কোম্পানির কাছ থেকে টিকা কেনে, তারা অনেক কম দাম দেয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায়। ফলে মুনাফা করার মতো পণ্য হিসেবে টিকা তেমন আকর্ষণীয় নয়। বিশেষ করে সেসব টিকা যেগুলো একজন মানুষকে জীবনে মাত্র একবার নিতে হয়।
১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২৬টি কোম্পানি টিকা তৈরি করতো। এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৫টিতে। কারণ ঔষধ কোম্পানিগুলো এখন রোগ প্রতিরোধে আগ্রহী নয়, তাদের আগ্রহ রোগের চিকিৎসায়।
তবে অবস্থা কিছুটা বদলেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান এবং বিল গেটস যুক্তরাজ্যে এইচপিভি টিকার দুটি ডোজের দাম প্রায় ৩৫১ ডলার। যুক্তরাজ্যে এটি শুধু ১২ আর ১৩ বছর বয়সীদের এটি বিনামূল্যে দেয়া হয়।
কিন্তু গ্যাভি নামের প্রতিষ্ঠানটি গরীব দেশগুলোতে কম খরচে টিকা দেয়ার লক্ষ্যে যে ব্যবস্থা চালু করেছে, তার অধীনে সেসব দেশে প্রতি ডোজ এইচপিভির খরচ পড়ে পাঁচ ডলারের মতো।
মুক্তবাজার নিয়ে উদ্বেগ
কাজেই ধনী দেশগুলোতে টিকা নিয়ে মুনাফার ভালো সুযোগ আছে। বিশেষ করে টিকা নিয়ে গবেষণা এবং এটি তৈরির প্রাথমিক খরচ তুলে আনতে।
ব্রিটেনের এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের হিসেবে একটা নতুন টিকা তৈরিতে প্রায় ১৮০ কোটি ডলার পর্যন্ত খরচ পড়ে।
“যদি আমরা বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেই, তাহলে কোভিড-নাইনটিনের টিকা কেবল ধনী দেশের মানুষেরাই পাবে”- বলছেন লণ্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক মার্ক জিট।
“এর আগে অনেক টিকা নিয়ে আমরা এরকম ঘটতে দেখেছি। কিন্তু এবার যদি এরকম কিছু ঘটে, সেটা হবে অনেক বড় এক ট্র্যাজেডি।”
ঐকমত্য
ইনোভিও যদি কোভিড-নাইনটিনের টিকা উদ্ভাবনে সফল হয়, এটির লাখ লাখ ডোজ তৈরির জন্য তাদের বড় কোন ঔষধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে পেৌঁছাতে হবে।
গত কয়েক বছরে অনেক ঔষধ কোম্পানি প্রকাশ্য অঙ্গীকার করেছে যে তারা সবাই যাতে টিকা পায় সেই লক্ষ্যে কাজ করবে।
গ্ল্যাক্সো-স্মিথ-ক্লাইন (জিএসকে) বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি ঔষধ কোম্পানি। কোভিড-নাইনটিনের টিকা আবিস্কারের অনেক উদ্যোগের সঙ্গে তারা জড়িত।
কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এমা ওয়ালমস্লে এক বিবৃতিতে বলেছেন, “কোভিড-নাইনটিনকে পরাস্ত করতে হলে স্বাস্থ্য খাতের সবাইকে এক সঙ্গেই কাজ করতে হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বিজ্ঞানী, শিল্প, বাজার নিয়ন্ত্রক, সরকার এবং স্বাস্থ্যকর্মী সবার মধ্যে সহযোগিতা এই বিশ্বমহামারী থেকে মানুষকে রক্ষা এবং একটা সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
গ্যাভির সেথ বার্কলিও বললেন একই কথা। একটা ইমিউনাইজেশন গ্যাপ এড়াতে হলে একটা সমঝোতা এবং সহযোগিতা জরুরী।
“একটা টিকা সবার জন্য সহজলভ্য করার কাজটি রাতারাতি হবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কেবল যাদের সামর্থ্য আছে তারাই কেবল এই টিকা পাবে।”
“যেসব জায়গায় এই টিকা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেখানে যদি আমরা এটা দিতে না পারি, তাহলে এই মহামারী চলতেই থাকবে।”